গল্পটা এইচএসসি পরীক্ষার্থী রাব্বীর, একজন সফল উদ্যোক্তার
যেখানে প্রচন্ড মেধাশক্তি কাজ করে সেখানে চমকপ্রদ বিশেষ কিছু হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না; শুধু একটু চিন্তার ধার ঘটানোই মুখ্য বিষয়। কিন্তু কথা হচ্ছে চিন্তাশক্তির অঢেল বিকাশ ঘটিয়ে মেধাকে কাজে লাগনোর জন্য বয়স কি আদৌ কোন বিষয়? উত্তরে নিশ্চয় বলবেন বয়স কোন বিষয়ই না। কেননা কিছু করে দেখানোর ক্ষেত্রে আসলে নির্দিষ্ট কোন বয়স লাগেনা। যেমনটা লাগেনি তানজিম রাব্বির ক্ষেত্রে।
দুরন্ত শৈশবের কিশোর তার দুরন্তপনা দিয়ে করে বসলেন দুরন্ত এক কাজ। মাত্র সতের বছর বয়সের টগবগে এ কিশোর নিজের মেধা এবং চিন্তাশক্তির অঢেল বিকাশ ঘটিয়ে তরুণদের জন্য বানিয়েছেন Taan-Raat নামে অসাধারণ এক প্ল্যাটফর্ম। এটা এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে দেশের প্রতিটা তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় আর্থিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাবে এবং দেশ পাবে তারুণ্যের শক্তিতে জ্বলে উঠার অতি সুন্দর ক্ষেত্র।
এত অল্প বয়সেই এত সুন্দর পরিকল্পনার কথা বলতেই হেসে উঠেন এই কিশোর। আর অকপটে বলতে লাগলেন দেখুন, আমার বয়স সতেরো মানে আমি ছয় হাজারেরও বেশি দিন পৃথিবীতে বেঁচে আছি, আলো-বাতাস খাচ্ছি। কিন্তু দেশ-সমাজ কিংবা পরিবারকে কী দিয়েছি? অথচ, পরিবার থেকে প্রতিনিয়ত ভোগ করছি, পরিবারের কর্তার ঘুমের স্বাদ মাটি করছি। শুধু আমি না আমার দেশের বেশির ভাগ তরুণ-ই একই কাজটি করছেন। মূলত, পরিবারের উপর নির্ভরশীলতা একটু কমিয়ে আনার চিন্তা থেকেই Taan-Raat Group চালু করেছি।
সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা ইব্রাহিম খলিল এবং গৃহিনী কোহিনুর বেগমের মেঝো ছেলে তানজিম রাব্বির পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা হলেও বাবার সরকারি চাকরির বদৌলতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার জন্ম। দুরন্ত শৈশবের এই কিশোর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ‘সূর্যমুখী কিন্ডার গার্টেন’ প্রাইমারি স্কুল থেকে সমাপনী পরীক্ষায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নবম হওয়ার কৃতিত্ব লাভ করে। এরপরে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের স্বনামধন্য ‘অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’-এ ভর্তি হয় তানজিম রাব্বি।
কিন্তু সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ‘অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’-এ পড়ার পর বাবার ট্রান্সফারের জন্য চলে আসতে হয় ঢাকায়। ভর্তি হয় রাজধানীর উত্তরা হাই স্কুল এন্ড কলেজে। যেখান থেকে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৫.০০ পাওয়ার কৃত্বিত অর্জন করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাতেও অর্জন করেন জিপিএ ৪.৭২। বর্তমানে সে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ আছে। পড়াশোনার পাশাপাশি রাব্বি বিতর্ক, বিজ্ঞান মেলা, কুইজ প্রতিযোগিতা, রেড ক্রিসেন্ট, প্যারেট, ডিসপ্লে, খেলাধুলা স্পেশালি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করে প্রায় অর্ধশতাধিক স্মারকে পুরস্কারপ্রাপ্ত। সম্প্রতি তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য তার দাঁড় করোনো বিজনেস প্ল্যাটফর্ম Taan-Raat গ্রুপের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
তরুণ-তরুণীদের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় আয়ের সুযোগ করে দেওয়া Taan-Raat গ্রুপ কিন্তু শুরুর দিকেই ছিল না। কোন সংগঠন ছাড়াই আড়াই-তিন বছর বিভিন্ন জায়গায় এক্টিভিটি ছিলো এই কিশোরের। এর পরে ইসরাত জাহান এবং ফয়সাল আহমেদ নামে দুই কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে তার একই মনোভাবের যোগসূত্রে Taan-Raat এর জন্ম হয় ২০১৯ এর ১২ সেপ্টেম্বর। প্রায় সমবয়সী এবং মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেড়ে উঠায় সবার চিন্তা-ভাবনার ব্যাপক মিলের পাশাপাশি নিজেদের সাবলম্বী হওয়ার একটি তীব্র ইচ্ছাই Taan-Raat সৃষ্টি করে। এই নামকরণ মূলত ফাউন্ডার দু’জনের নামানুসারে।
বর্তমানে Taan-Raat গ্রুপের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, গ্রাফিক্স ও আইটি ফার্ম ডিপার্টমেন্ট, শিক্ষা ও সহশিক্ষা ডিপার্টমেন্ট, ফটোগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট, চিত্রাঙ্কন ডিপার্টমেন্ট, ভ্রমণ বিষয়ক ডিপার্টমেন্ট এই ছয়টি ডিপার্টমেন্টে হাজারো কাজ করার সুযোগ তৈরি করেছেন। এছাড়াও পাবলিক লাইব্রেরি, এডুকেশন সেন্টার, রেষ্টুরেন্ট, গিফট শপ, দেশি শাড়ি বিতান, ফ্যাশন হাউজ, রেডিও চ্যানেল, টেলিভিশন চ্যানেল ইত্যাদি ডিপার্টমেন্ট খোলার চিন্তায় আছেন। অদূর ভবিষ্যতে বেশ বড়সড়ো পার্টনারশিপ এবং Taan-Raat গ্রুপের লাইফ টাইম স্পন্সরের মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টায় আছেন। এসকল সব ডিপার্টমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য অসাধারণ এক প্ল্যাটফর্ম তৈরীর প্রচেষ্টায় আছেন তারা।
তাদের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে পঁচিশ ধরনের ইভেন্ট আছে এসব ইভেন্টের সাফল্যও পেয়েছেন তারা। ত্রিশটির-ও অধিক বিবাহ অনুষ্ঠান এবং গায়ে হলুদসহ জন্মদিনের অনুষ্ঠান, জাতীয় প্রতিযোগিতামূলক উৎসব, বৃত্তি পরীক্ষা এবং ওয়ার্কশপ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত শতাধিক ছোট-বড় অনুষ্ঠান সফলভাবে আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এই ডিপার্টমেন্ট থেকে অসংখ্য তরুণ-তরুণীর ইচ্ছে অনুযায়ী আয় করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
বয়সে ছোট বলে প্রথমে অনেক বাধাঁর সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। সবাই মূল কনসেপ্ট সম্পর্কে না জেনেই তাদের নিয়ে হাসাহাসি করত, ছোটো করে দেখত, তাচ্ছিল্য করত। বিভিন্ন সমপর্যায়ী সংগঠনগুলো থেকেও কিছু চাপ ছিল। কিন্তু প্রধান এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের বাঁধা ছিল পৃষ্টপোষকের অভাব। শুরুর দিকে তরুণদের নিয়ে বেশ কিছু ইভেন্ট-এর পরিকল্পনা করেও স্পন্সর এর অভাবে সে ইভেন্টগুলো আয়োজন করতে পারেনি তারা।
বিভিন্ন পৃষ্টপোষক কোম্পানীর কাছে দিনের পর দিন ঘোরার পরও শুধুমাত্র বয়সে ছোট বলে তাদের কেউ স্পন্সর দেয়নি। পরিবার থেকেও ছিল বিভিন্ন মনমানিল্য; নিজের তীব্র ইচ্ছায় অনেকটা পরিবারের বিরুদ্ধে জোর করেই কাজ করতে হয়েছে। আশেপাশের মানুষের কাছে হাসি-ঠাট্টার পাত্র হতে হয়েছে, বহুবার শিক্ষকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের স্বীকার হতে হয়েছে, সহপাঠীদের বিনোদনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হতে হয়েছে। কিন্তু একেবারেই যে সাপোর্ট পায়নি তাও না। যখন সে কারিকুলাম এক্টিভিটি ‘বি ই ড স’-তে আষ্টেপৃষ্ঠে যুক্ত হয়েছে তখন থেকেই মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটেছে তার, সেখানকার প্রতিটা সিনিয়র ভাইয়ের অসংখ্য সাপোর্ট এবং Taan-Raat গ্রুপের এর অন্য একজন প্রতিষ্ঠাতা ‘ইসরাত জাহান’ ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা ‘ফয়সাল আহমেদ’- এর সাপোর্টে অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলে। প্রচন্ড ইচ্ছে শক্তি তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। নিজেদের কঠিন শ্রম ও মেধার বিকাশ ধীরে ধীরে তাদের সর্বজনগৃহীত করে তুলেছে।
Taan-Raat এর প্লাটফর্মে নতুন যারা যুক্ত হতে চায়, তাদের Taan-Raat গ্রুপের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/taanraatmanagement এর জব স্টেশনে থাকা আবেদন ফর্ম পূরণ করলেই তাদের সাথে গ্রুপের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যোগাযোগ করবেন। অথবা নতুন সদস্যরা তাদের তথ্য সম্বলিত একটি মেসেজ (পুরো নাম, আগ্রহী ডিপার্টমেন্টের নাম এবং সেল ফোন নম্বর ) পেইজে সেন্ড করলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের সাথে যোগাযোগ করবেন।
কারো নতুন আইডিয়া নিয়ে নতুন করে কিছু শুরু করার চেষ্টা থাকলে Taan-Raat গ্রুপ তাদেরকে অনেক অনেক অগ্রীম শুভকামনা জ্ঞাপন করে। নতুন কোনো আইডিয়া বা প্লাটফর্ম তৈরির ইচ্ছা থাকলে কে কী বললো অথবা কে কি বলবে, তা না ভেবে শুধুমাত্র নিজের আইডিয়াকে আরও স্ট্রং করে, নিজের প্রতিটা নেটওয়ার্কিং লিংক কাজে লাগিয়ে নিজের সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করার প্রতি জোর দেওয়াকেই উচিত মনে করেন তারা।