বুয়েটের সেই ইফতি এখন রকেট ইঞ্জিনিয়ার
হাসান সাদ ইফতি। শৈশব কেটেছে ঘর আর হাসপাতালে। সমবয়সীদের খেলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতেন। স্বপ্ন দেখতেন রকেট বানিয়ে আকাশে উড়বেন। সেই অসুস্থতা জয় করে উচ্চমাধ্যমিকের পর স্বপ্নের বিষয় রকেট সায়েন্সে পড়তে ইফতি যান জার্মানিতে ।
হাইপারসনিকস বিষয়ে এখন তিনি পিএইচডি করছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বপ্নটাও এখনো দেখেন। তার রকেট ঘুরে বেড়াবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। আসুন জেনে নেয়া যাক তার কঠিন পথচলার গল্প।
ইফতির বাবা লুৎফুল হাসান তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। বিদেশ থেকে ফেরার সময় একবার উড়োজাহাজের বই এনে দিয়েছিলেন। ইফতি বলেন, ‘সেই বইয়ে বোয়িং ৭৪৭-এফ, আমেরিকার স্পেস শাটল এবং রুশ স্পেস শাটল বুরানের ছবি ছিল। হাসপাতালে বসে আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন নিজের তৈরি রকেটে ঘুরে দেখব জগৎটাকে।’
লুৎফুল হাসান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখন। ছেলের আগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ছেলেদের সময় দেওয়ার চেষ্টা করেছি সব সময়। বুঝেছিলাম, উড়োজাহাজ বিষয়ে ওর প্রচণ্ড আগ্রহ। তাই ওকে খেলনা উড়োজাহাজ, বই এনে দিতাম। ছেলেমেয়েদের শুধু ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার বানানোর চেষ্টা না করে তাদের আগ্রহটা বোঝা জরুরি।’
হাসান সাদ ইফতি আর বেঁচে নেই- এমন ধারণা করে খুলে ফেলা হয়েছিলো কৃত্রিম শ্বাস–প্রশ্বাসের সংযোগ। অচেতন ছেলে আর চিকিৎসকদের অসহায় মুখ দেখে মুষড়ে পড়েন মা সেলিনা সুলতানা। তবে বাবা লুৎফুল হাসান আশা ছাড়লেন না।
চিকিৎসকদের অনুরোধ করলেন শেষবারের মতো চেষ্টা করতে। তখন একটা মিরাকল ঘটে গেল। ফিরে এসেছেন তিনি। এরপর প্রায় ২০ বছর কেটে গেছে। সেই ইফতি এখন রকেট বিজ্ঞানী।
‘রকেট সায়েন্স’ যে বেশ কঠিন, ওই রকেট সায়েন্সের মতোই কঠিন ছিল ইফতির শৈশব। তবে তাঁর কাছে রকেট সায়েন্স অতটা কঠিন নয়। তার ছেলেবেলার বিষয়ে মা সেলিনা সুলতানা বলছিলেন, মিরাকল ঘটলেও হাঁপানি রোগটি ইফতির পিছু ছাড়েনি। একবার অবস্থা ভীষণ খারাপ হলে শিশু বিশেষজ্ঞ এম আর খানের কাছে ছুটে গেলাম। তিনি একটি ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলেন।
তিনি জানান, এতে ওর জীবন–মরণের সম্ভাবনা–শঙ্কা ফিফটি ফিফটি। ইনজেকশন দেওয়ার পর টানা ১৫ ঘণ্টা ইফতি তার কোলে শুয়ে থাকল। অবশেষে চিকিৎসক বলেন, ওকে বিছানায় দিতে পারেন, শঙ্কা কেটে গেছে।
ইফতি এখন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন রকেট সায়েন্সে। ২০১৫ সালে সেখানে ভর্তি হন তিনি। পিএইডি করছেন হাইপারসনিকস নিয়ে।এতে সফল হলে উড়োজাহাজের মতো রকেটেও যাতায়াত করতে পারবে মানুষ। ইফতি বলেন, ‘তরুণদের বলব, তুমি পারো না, এমন কিছু নেই। সবাই তোমাকে না বললেও, নিজেকে কখনো না বোলো না।’
ইফতি নিয়মিত বই পড়েন, ঘুরতে যান, ছবি আঁকেন, কলম সংগ্রহ করেন, ক্রিকেট খেলেন আর স্কুলে শিশুদের বিজ্ঞান নিয়ে অনুপ্রেরণা দিতে কথা বলেন। রকেট সায়েন্স নিয়ে তাঁর জবাব, ‘রকেট সায়েন্স অতটা কঠিন নয়। পরিশ্রম করলে যে কেউ রকেট–বিজ্ঞানী হতে পারে।’
ইফতি বলেন, ‘ছেলেবেলায় দিনগুলো কাটত ঘরে কিংবা হাসপাতালে। কথা বলার তেমন কেউ ছিল না। ফলে কথা বলার দক্ষতা না থাকায় যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, তখন নতুন করে বাংলাও শিখতে হয়েছে।’
চার ভাইয়ের মধ্যে ইফতি দ্বিতীয়। বাবার চাকরিসূত্রে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই বেড়ে উঠেছেন। মা লেখাপড়া করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। পরে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য যান জাপানে। সেখানে বছর তিনেক কাটান ইফতি।
একসময় তার আরেক সমস্যা হয়ে উঠে প্রতিবেশী। প্রায়ই বাসায় এসে পরামর্শ দিতেন, ‘ওকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না, একটা মুদির দোকান করে দিন।’ দেয়ালের ওপাশ থেকে সব শুনে ভেঙে পড়তেন ইফতি। মা-বাবাও আর্থিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ফলে প্রতিবেশীদের পরামর্শ ছিল যন্ত্রণার আরেক নাম।
সে সময় ইফতিকে সাহস জুগিয়েছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের গণিত শিক্ষক রফিকুল জুয়েল। ফেসবুকে সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে ইফতি জানান, ‘নবম শ্রেণিতে জুয়েল স্যার আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘তুই চেষ্টা কর। তুই অনেক ভালো করবি।’ ওই কথাগুলো আমার কাছে ছিল অমূল্য। আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বেড়ে গেল। পড়াশোনায় সময় দিতে শুরু করলাম অনেক বেশি। সঙ্গে মানুষের নেতিবাচক মন্তব্যগুলো অগ্রাহ্য করতে শিখলাম।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ২০০৬ ও ২০০৮ সালে। ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে। আরও বড় সুযোগ আসে কদিন পর। ২০০৯ সালে রকেট সায়েন্সে পড়তে ইফতি পাড়ি জমান জার্মানিতে। ভর্তি হন স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জার্মানিতে প্রথম তিন মাস ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। পরীক্ষার আগের রাতে রেস্তোরাঁয় বসে অঙ্ক করেছেন। কিন্তু বাবা একসময় জার্মানিতে ছিলেন। চাইলেই ছেলেকে সুবিধা দিতে পারতেন। লুৎফুল হাসান বলেন, ‘আমি চেয়েছি, ছেলে স্বাবলম্বী হোক। কষ্ট করলে আত্মবিশ্বাসী হয় মানুষ।’
ছেলেবেলা থেকে ধৈর্যের যে শিক্ষাটি পেয়েছেন, সেটিও কাজে লেগে যায় এয়ারবাসে ইন্টার্ন করার আগে। ৪০ বার আবেদনের পর এয়ারবাস থেকে ডাক আসে। ইফতি বলছিলেন, ‘বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলাম, তখন ভাবতাম, কী করে আরও ভালো করা যায়। জানতাম, এয়ারবাসে ইউরোপীয় না হলে সুযোগ পাওয়া কঠিন।’
ইফতির মা বলেন, ‘এয়ারবাসে সুযোগ পাওয়ার পর ইফতি আমাকে ফোন করে বলে, ‘বলো তো মা, আমি কেন সুযোগ পেলাম?’ আমি বলি, ‘তুমি যে ভালো ছেলে।’
তিনি জানান, ‘বড় ছেলে হাসান সামি আদনান চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবার গবেষক, জার্মানিতে আছে। ইফতি দ্বিতীয়। তৃতীয় ছেলে হাসান ইমরান মাসুদ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালেয় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আর ছোট ছেলে হাসান রিশাদ ইউসুফ সঙ্গেই আছে। দশম শ্রেণিতে পড়ছে।’
এয়ারবাসেও যোগ্যতার পরিচয় দেন ইফতি। তাঁর গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটি এখন দিনে কয়েক মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছে। তিনি বলেন, ‘এয়ারবাসে উড়োজাহাজের সব যন্ত্রাংশ সংযোগ করে ফ্লাইট টেস্টের পর এয়ারলাইনসের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কোনো সমস্যা হলে সময়মতো এয়ারলাইনসের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। ফলে ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়; যা কয়েক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমি হাইড্রোলিক্সের সমস্যার সমাধান দিয়ে একটি প্রক্রিয়া তৈরি করি, যা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান দ্রুত করা যায়।’ এয়ারবাসে এক বছর কাজ করার পর ইফতি বুঝতে পারেন তিনি গবেষণা করতে চান। সুযোগও পেয়ে যান। স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর একজন জার্মানকে পাঠানো হয় গবেষণা করতে।
এরই আওতায় ইফতি যুক্তরাষ্ট্রে যান জার্মানির প্রতিনিধি হিসেবে। এর জন্য পান এরিক–বেকার বৃত্তি। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর গবেষণা ছিল সুপারসনিক উড়োজাহাজ নিয়ে।