প্রতিজ্ঞা করেছিলাম— বিসিএস ক্যাডার হবই
তখন সম্ভবত মাভাবিপ্রবিতে তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ি। আমার ডিপার্টমেন্ট ছিল বায়োটেকনোলজি। দেশের বাজারে এ সাবজেক্ট রিলেটেড চাকরি নেই বললেই চলে। এটা নিয়ে সিএসই, আইসিটি ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা খুব ব্যঙ্গ করতো। কারণ চাকরির বাজারে তাদের সাবজেক্টের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। এ নিয়ে কিছু বলতেও পারতাম না, আবার সইতেও পারতাম না।
চতুর্থ বর্ষে উঠে চোখে রীতিমতো সরষে ফুল দেখতে শুরু করি। ওরা যেখানে চাকরিতে ঢুকার অপেক্ষায় আমি তখন ভবিষ্যৎ বেকারত্বের শঙ্কায় অন্ধকারের পথে পা বাড়াচ্ছি। চরম হতাশা লাগতো ঐ সময়টায়। ভাবতাম আমাকে দিয়ে আর কিচ্ছু হবেনা। একে তো ব্যাকবেন্ঞ্চার তার উপর দেশের প্রেক্ষিতে ননডিমান্ডেবল একটা সাবজেক্টে পড়েছি।
বিষণ্ণতা আমাকে রীতিমতো পেয়ে বসেছিলো। বন্ধুদের আড্ডা হৈ হুল্লোড় আমাকে তখন আর টানতো না। মাঝে মাঝে মনে হতো জন্মই আমার আজন্ম পাপ। বাবার কষ্টার্জিত অর্থ ধ্বংস করে যদি পড়ালেখা শেষে তার হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে না পারি তবে কেমন পুত্র আমি! ক্লাসমেটরা অনেকেই বিদেশে পড়ালেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করতে মনটা কোনভাবেই সায় দিচ্ছিলো না।
আমার পাশের রুমে সিপিএস (ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স) ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাই ছিলেন, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি। তার কাছে মাঝে মাঝে হতাশাগুলো শেয়ার করতাম। তিনি আমাকে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন। আর আমার বড় ভাইও তখন বিসিএস দিচ্ছিলেন। তিনি সাহস দিলেন অতীতকে ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকাও, ভবিষ্যতটা এখনও তোমার শেষ হয়ে যায় নি। তার পরামর্শে বিসিএসের একসেট বই কিনে আল্লাহর নাম নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করি। কিভাবে যেন বিসিএসের পড়াগুলো আমার ভালও লাগতে শুরু করে। মাঝে মাঝে মনে হতো এই একটা জায়গা যেখানে আমার পক্ষে কিছু একটা করে দেখানো সম্ভব।
মাভাবিপ্রবি অধ্যায় শেষ করে ঢাকায় চলে আসি আর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএতে ভর্তি হই। রাতে ক্লাস থাকায় সারাদিন বিসিএসের পড়াশোনা করতে সুবিধা হতো। এরই মধ্যে ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পাশ করে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট দেয় প্রায় ৭-৮ মাস পর। কিভাবে যেন লিখিত পরীক্ষাতেও টিকে যাই। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে আমার বিসিএসের ক্ষুধাটা কেন জানি আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। প্রতিজ্ঞা করি ক্যাডার আমাকে হতেই হবে। প্রথমবারের মত কোন চাকরির ভাইবায় অংশগ্রহণ করি ৩৪তম বিসিএসের মাধ্যমে। ভাইবা খারাপ করায় ক্যাডার প্রাপ্তির প্রত্যাশাটা ছিল কম। তবে ক্যাডার না পেলেও ননক্যাডার থেকে কলকারখানা পরিদর্শকের একটা চাকরি পেয়ে যাই। আল্লাহ সহায় থাকায় খুব বেশিদিন আমাকে বেকার থাকা লাগে নি।
চাকরি পেলেও ক্যাডার প্রাপ্তির সুপ্ত আশাটা কখনোই নিভে যায় নি। বাবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে না পারায় ৩৫ তম ভাইবাতে খুবই খারাপ করি। পরীক্ষা বেশ ভাল হলেও ৩৬ তম বিসিএসে ক্যাডার না পাওয়াতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। অবশেষে সেই ক্যাডারের দেখা পাই ৩৭তম তে এসে।মাঝের এই ২/৩ টা বছর কি পরিমাণ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছি তা আমি জানি আর আল্লাহ্ জানেন। বিশ্বাস ছিল পরিশ্রম করলে আল্লাহ আমাকে অবশ্যই ভাল কিছু দিবেন। পরম করুণাময় আমাকে নিরাশ করেন নি। মহান আল্লাহর প্রতি আমৃত্যু এ কৃতজ্ঞতা জানিয়েও আমি শেষ করতে পারবো না।
আজকে আপনার বন্ধুদের সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, তারা আপনাকে নিয়ে উপহাস করছে তার জবাবটাও দিতে পারছেন না। এ এক চরম অন্তর্জ্বালা। এর উপর্যুক্ত জবাব দিতে সাফল্য এবং সাফল্যই একমাত্র হাতিয়ার। নিজেকে শাণিত করুন ক্ষুরধার প্রস্তুতির মাধ্যমে। আপনার সাফল্য ঐ বন্ধুদের মনে জ্বালা ধরাবেই। আপনার জন্য নিরন্তর শুভকামনা। আল্লাহ হাফেজ।
লেখক: এএসপি, ৩৭তম বিসিএস, মেধাক্রম-৮