অপরাহ উইনফ্রে: নাপিতের মেয়ে থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপস্থাপক
অপরাহ উইনফ্রে। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী নারী। মাত্র নয় বছর বয়সে যে কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং এই নির্যাতন সইতে না পেরে একপযার্য়ে বস্তি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কে জানত এই কিশোরীই একদিন সারা বিশ্বে সফল নারীর দৃষ্টান্তে পরিণত হবেন! অপরাহ উইনফ্রে নিজেও কি জানতেন সে কথা? ওয়েবসাইট ঘেঁটে তার গল্প সাজিয়েছেন- মোহাম্মদ ইয়ামিন
‘স্বপ্ন দেখো। নিজের বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে পিছিয়ে যেয়ো না। নিজের চেয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। জীবনের লক্ষ্যকে যত দূর সম্ভব সামনে নিয়ে যাও। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, স্বপ্ন সফল হবেই।’
১৯৯৭ সালে ওয়েলেসলি কলেজের সমাবর্তনে স্বপ্নচারি তরুণ গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে এসব কথা বলেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী কৃষ্ণাঙ্গ উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রে। তাঁর বিশ্বখ্যাতি ও জনপ্রিয় শো 'দি অপরাহ উইনফ্রে'র জন্য এই উপস্থাপককে আমেরিকার টক'শো ফার্স্ট লেডি বলা হয়। ১৯৮৬ সালে শুরু হওয়া এই শো শেষ হয় ২০১১-তে। এখন অপরাহ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক নামে নিজেরই একটি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মালিক। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বের একশ জন সর্বোচ্চ প্রভাবশালী মানুষের তালিকায় অপরাহ উইনফ্রে একমাত্র ব্যক্তি; যিনি টানা আটবার নির্বাচিত হয়েছেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও হিলারি কিনটন নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র পাঁচবার। আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও অপরাহ উইনফ্রেকে আমেরিকার সম্ভাব্য সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী বলে মনে করেন।
কিন্তু মিসিসিপিতে দরিদ্র নাপিত বাবার ঘরে জন্ম নেয়া অপরাহ উইনফ্রের জীবনের শুরুটা ছিল নানা বাধা আর প্রতিকূলতায় ভরা। জন্মের পর বাবা মায়ের বিচ্ছেদের কারণে শৈশব টাকাতে হয় নানির কাছে। সেই ছোট বয়সেই গির্জায় কাজ করে উপার্জন করতে হয়েছে তাকে। এরপর নানা বাধা বিপত্তি পার হয়েছে অপরাহকে। ১৯৯৭ সালে ওয়েলেসলি কলেজের সমাবর্তনে নিজের জীবনের সেইসব প্রতিকুলতার কথা বলেছেন উইনফ্রে। যা আজও অনুপ্রেরণা দেয় জীবনের লক্ষ্য খুঁজে ফেরা তরুণদের। তাঁর সেদিনের সেই বক্তব্যের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
‘তোমাদের সবাইকে আমার অভিবাদন ও প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। আজ এখানে এসে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। একসময় আমিও এই কলেজে পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার কোনো স্কলারশিপ ছিল না বলে তা হয়ে ওঠেনি। আমি তোমাদের নিয়ে সত্যিই গর্বিত।
আজ আমি তোমাদের কাছে পাঁচটি বিষয় তুলে ধরব, যা আমাকে জীবন সাজাতে শিখিয়েছে। প্রথমত, জীবন একটা ভ্রমণ। ওয়েলেসলির একটি দিক আমার খুবই ভালো লাগে। এখানে মেয়েদের তাদের জীবনের সবটুকু সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করতে দেওয়া হয়; নিজেদের সত্তাকে চিনতে উৎসাহিত করা হয়।
আমার এ ব্যাপার বুঝতে বেশ দেরি হয়েছিল যে প্রতিদিনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাগুলো দিয়েই নিজেকে আবিষ্কার করে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া যায়। আমি বহুদিন ধরে নিজেকে চিনতে পারিনি। নিজে যা নই, তা-ই হতে চেয়েছি। আমার বয়স যখন ১০, টিভিতে ডায়ানা রসকে দেখে আমি ঠিক তাঁর মতো হতে চাইতাম। অনেক দিন পর বুঝলাম, আমি যতই ডায়েট করি, আমার দৈহিক গড়ন ডায়ানার মতো হবে না।
টেলিভিশনে কাজ শুরুর প্রথম দিকে আমার বার্তা পরিচালক আমাকে এমন কিছু একটা বানাতে চেয়েছিলেন, যা আমি নই। তাঁর মতে, আমার চুল ছিল অতিরিক্ত ঘন। তাই আমি নিউইয়র্কের এক বিউটি পারলারে গিয়ে হাজির হলাম। তারা আমার চুলে যে কসমেটিকস ব্যবহার করল, তাতে আমার মাথার তালু পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছিল। কিন্তু তখনকার আমি আজকের অপরাহ ছিলাম না। আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি যে আমার চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। পরের এক সপ্তাহের মধ্যে আমার মাথার প্রায় সব চুল পড়ে গেল। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যার মাথায় চুল বলতে কিছুই নেই, সেই অবস্থায় আমি টেলিভিশনে উপস্থাপক হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তখন আমি নিজেকে চিনতে পারি, বুঝতে পারি আমি ডায়ানা রস কিংবা বারবারা ওয়াল্টারস নই, যাঁদের মতো আমি হতে চেয়েছিলাম।
এভাবে ভুল করতে করতেই অনেক কিছু শিখেছি আমি। অনেক ভুল করার পর বুঝেছি, নিজেকে ‘বারবারা’ বানানোর চেয়ে দারুণ একজন ‘অপরাহ’ বানানোই অধিকতর যুক্তিসংগত। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বারবারাকে দেখে আমি শিখব, কিন্তু আমি ‘অপরাহ’কে ছাপিয়ে বারবারা হতে চাইব না। আজ আমার এই সাফল্যের মূলে রয়েছে নিজেকে চিনতে পারা, নিজের মতো থাকা। নিজের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যকে আবিষ্কার করা এবং সেই সত্যের কাছে দায়বদ্ধ থাকা।
শোককে শক্তিতে পরিণত করো। জীবনে অনেক আঘাত পাবে, অনেক ভুল করবে। এসব দেখে অনেকে তোমাকে বলবে, তুমি ব্যর্থ। কিন্তু বিশ্বাস করো, যা তুমি ব্যর্থতা বলে মনে করছ, তার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর আসলে তোমাকে বলছেন, ‘তুমি ভুল পথে চলছ।’ নিজেকে ব্যর্থ ভেবে হতাশ হয়ো না। এটা একটা অভিজ্ঞতা মাত্র। একে কাজে লাগাও।
একসময় বাল্টিমোরে আমাকে টেলিভিশনে সাংবাদিকতা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, আমি এ কাজের যোগ্য নই। কারণ, আমি নেতিবাচক খবর উপস্থাপন করতে করতে কেঁদে ফেলতাম। ধরো, কোথাও আগুন লেগেছে আর সাংবাদিক নিজেই তা বলতে বলতে গৃহহারা মানুষের জন্য কেঁদে ফেলছে। ব্যাপারটা মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত না আমার পদাবনতি হলো আর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ‘টক শো’ করার জন্য, তত দিন পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি, আমার ভেতরে কী সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে।
সেই ১৯৭৮ সালে যেদিন আমি প্রথম টক শো উপস্থাপনা করি, এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে গিয়েছিল। যেন নিজের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি নিজের ভুলেই সাংবাদিকতা থেকে বাদ পড়েছিলাম, যেটাকে আমার ক্যারিয়ারের এক বিরাট ব্যর্থতা মনে হতে পারে, কিন্তু আমি সেই ভুল থেকেই টক শোর জগতে প্রবেশ করি। আর এই ক্যারিয়ার আমাকে নিঃসন্দেহে ব্যর্থতা দেয়নি!
আমার বয়স যখন ১৫, তখন থেকে আমি ডায়েরি লেখা শুরু করি। ১৫-১৬ বছরের লেখাগুলো সব প্রেমঘটিত জটিলতায় ভরা! কিন্তু যত বড় হয়েছি, তত আমি বর্তমানকে গ্রহণ করতে, ভালোবাসতে শিখেছি। আমি বলব, তোমরাও প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকাকে উপভোগ করো। যেসব জিনিসের জন্য তুমি জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ, তা একটা ডায়েরিতে লেখো। আজ সারা দিনে ঘটে যাওয়া যেসব ঘটনার জন্য তুমি কৃতজ্ঞ, এমন পাঁচটি ব্যাপার লিখে রাখার অভ্যাস করো। এতে সারা দিন নিয়ে, এমনকি জীবন নিয়ে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। তোমার যা আছে, তার প্রতি তুমি যখন মনোযোগ দিতে শিখবে, তখন দেখবে পৃথিবীতে কোনো কিছুর কমতি নেই। আর যদি কী নেই, কী পেলাম না—সে হিসাব মেলাতে ব্যস্ত থাকো, তা হলে কোনো কিছুই আর তোমাকে সুখী করতে পারবে না।
জীবনে স্বপ্ন দেখার কোনো সীমা নেই। তোমার লক্ষ্যকে ও স্বপ্নকে আকাশ ছাড়িয়ে যেতে দাও। কারণ, তুমি যা বিশ্বাস করবে, তুমি তা-ই হবে। আমি যেখানে জন্মে, যেভাবে বড় হয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, যত দূর আসতে পেরেছি, এ থেকেই বোঝা যায় অসম্ভব বলতে কিছুই নেই। আমার মধ্যে অসাধারণ কিছুই ছিল না; তবু আমি পেরেছি।
স্বপ্ন দেখো। নিজের বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে পিছিয়ে যেয়ো না। নিজের চেয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে হবে তোমাদের। জীবনের লক্ষ্যকে যত দূর সম্ভব সামনে নিয়ে যাও। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, স্বপ্ন সফল হবেই। ধন্যবাদ।’’ [ওয়েবসাইট অবলম্বনে]