ভাইভা বোর্ড হলো অভিনয় মঞ্চ, ‘নার্ভাসনেস’ বুঝতে না দেওয়াই কৌশল
মৌখিক পরীক্ষাতে শুধু আপনার জ্ঞানের দক্ষতাই যাচাই-বাছাই নয় বরং— আপনার ব্যক্তিত্ব, মানসিক শক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি, অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগের ক্ষমতা ইত্যাদি গুণাবলী যাচাই করেন। কথাগুলো বলছিলেন ৩৭তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত শেখ সুরাইয়া ঊর্মি। তিনি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেন। বিসিএস ভাইভা বোর্ডের অভিজ্ঞতা ও ভাইভার প্রস্তুতি নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করেন এম এম মুজাহিদ উদ্দীন। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো এই অভিজ্ঞতার গল্প।
বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ২০০ এক্ষেত্রে ভালো করতে পারলে ১৭০ থেকে ১৮০ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব। আমি ৩৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই লিখিত পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করেই মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। মৌখিক পরীক্ষাতে পরীক্ষকগণ শুধু আপনার জ্ঞানের দক্ষতাই যাচাই করেন না বরং— আপনার ব্যক্তিত্ব, মানসিক শক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি, অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগের ক্ষমতা ইত্যাদি গুণাবলী যাচাই করেন।
কারণ একদিন হয়ত আপনিই দেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হবেন। আপনার একটি সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে এদেশের হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য। আর এ সকল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন কিছুটা সময় সাপেক্ষ। প্রস্তুতির শুরুতে আমি আমার দুর্বল দিকগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে থাকি। সেই সাথে আমার ভালো দিকগুলোকে আরো ভালো করার চেষ্টা করতে থাকি।
আমি নিয়ম করে কিছু কাজ করতে শুরু করি। কাজগুলোর মধ্যে—
* কথা বলার সময় প্রমিত বাংলা। যাকে আমরা শুদ্ধভাষা বলে থাকি। সেই ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতাম। যেকোনো ধরনের আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করার চেষ্টা করতাম। কথা বলার সময় সচেতন থাকতাম যেনো ইংরেজিও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ না হয়ে যায়। যে কারোর চোখের দিকে তাকিয়ে সাবলীলভাবে কথা বলার চেষ্টা করতাম।
* আমি নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি খবর দেখতাম। কথা বলার সময় তাদের বাচনভঙ্গি এবং অঙ্গভঙ্গি খেয়াল করতাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা ও ইংরেজি যেকোনো বিষয়ে অনর্গল কথা বলার চেষ্টা করতাম।
* প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার একটা অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম। সম্পদকীয়টা বেশ মনযোগ দিয়ে পড়তাম। আপনি যদি নিয়ম করে সম্পাদকীয়টা খুব মনোযোগ সহকারে পড়েন। তবে মনের অজান্তে যেকোনো ঘটনা বিশ্লেষণ, তা উপস্থাপন করার কৌশল, শব্দ চয়ন ইত্যাদিতে অবিস্মরণীয় পরিবর্তন আসবে।
* যেসব বিষয় থেকে সাধারণত প্রশ্ন করে থাকে তাহলো— মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অর্জন, বঙ্গবন্ধু, নিজ জেলা, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, সাম্প্রতিক বিষয় প্রভৃতি জানার চেষ্টা করতাম।
পোশাক পরিচ্ছদ: বাংলায় একটা প্রবাদ আছে— ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। কথাটা কিন্তু আসলেই সত্যি। আপনি যখন ভাইভা বোর্ডে প্রবেশের জন্য রুমের দরজা খুলে প্রবেশের জন্য অনুমিত চান, ঠিক তখন থেকেই আসলে আপনার পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। তারপর শেষ হয় আপনি রুম ত্যাগ করার পরে। আপনাকে দেখে যদি ভাইভা বোর্ড মেম্বারদের ভালো লাগে, তবে তা অবশ্যই ইতিবাচক। মনের অজান্তেই তারা আপনার উপর সদয় হবেন। আর যদি বিরক্ত হন, তবে তার ফল উল্টাটাই হবে।
আমি আমার মৌখিক পরীক্ষার পোশাক নির্বাচন করেছিলাম অনেক সতর্কতার সাথে যেনো তার রং, ধরণ ইত্যাদি ঠিক ও মার্জিত হয়। একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার যেভাবে পোশাক পরা উচিত সেভাবেই পরার চেষ্টা করেছিলাম।
অভিজ্ঞতা: মৌখিক পরীক্ষার সময় এমন একটা অনুভূতির সম্মুখীন হই, কখনো এর সম্মুখীন হয়নি— তা বলে বোঝানো যাবে না। আপনার যত ভালো প্রস্তুতিই থাকুক না কেনো, আপনি নার্ভাস হবেনই। তবে যে যত কম হবে ততই ভালো। বেশি নার্ভাস হলে আপনার পরীক্ষা কখনোই ভালো হবে না। অনেক জানা বিষয় আপনাকে জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দিতে পারবেন না। আমাদের বোর্ডে আমরা ১৫জন ছিলাম আমি ১২তম নম্বরে ছিলাম। শুরুতে কিছুটা নার্ভাস ছিলাম।
কিন্তু পরে মনে হলো আমি নার্ভাস হলে আমার পরীক্ষা কোনোভাবেই ভালো হবে না। প্রস্তুতির কথা স্মরণ করে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম আমার না হলে আর কারোই হবে না (মন মানছিল না তাও জোর করে বিশ্বাস করার চেষ্টা করছিলাম)। কিছুক্ষণ পরে সত্যিই আমার কেমন যেনো নার্ভাস লাগছিল না। অবশেষে আমার ডাক পড়লো আমি আস্তে করে রুমে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলাম। অনুমিত দেয়ার কাছে গিয়ে সালাম দেই। স্যাররা আমার সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন।
প্রথমে আমার নামের অর্থ, কে রেখেছে নাম, কেনো রেখেছে, এই নামে বিখ্যাত কেউ আছে কিনা প্রভৃতি জিজ্ঞাসা করলেন। যেহেতু তার প্রশ্নগুলো ইংরেজিতে করেছিলেন তাই আমিও ইংরেজিতে উত্তর দিয়েছিলাম। তারপর আমার দোষ-গুণ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমার গুণগুলোকে খুব হাইলাইট করে বলেছিলাম আর দোষগুলোকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিলাম। আমি কিছু বিষয় সম্পর্কে খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তাই স্যাররা যখন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন আমি এমনভাবে উত্তর দিচ্ছিলাম যাতে আমার উত্তরগুলোর মাঝেই কাঙিক্ষত বিষয়গুলো আসে।
আর পরবর্তী প্রশ্নগুলো যেনো ওই টপিক থেকেই করেন। কারণ প্রশ্নকর্তা কখনোই প্রশ্ন আগে থেকে লিখে রাখেন না। আপনার উত্তর থেকেই তারা পরবর্তী প্রশ্ন তৈরি করেন। আমি কোনো প্রশ্ন উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক ছিলাম। যেনো এমন কোনো কিছু বলে না ফেলি যে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। এই কৌশল অবলম্বন করে সফল হয়েছিলাম। আমার জেলা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, সংবিধান, আমার পছন্দক্রম ইত্যাদি থেকে প্রশ্ন করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তাও অশেষ কৃপায় দুই একটা প্রশ্ন ছাড়া আমি প্রায় সবগুলোরই উত্তর করতে পেরেছিলাম। কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর আমাকে দ্বিধায় ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তবে আমি যেহেতু জানতাম আমার উত্তর ঠিক তাই ভদ্রতার সাথেই আমার উত্তর স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলাম। আমার যুক্তি শুনে বোর্ড মেম্বাররা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তারা আমার উত্তরে সন্তুষ্ট।
আমি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের মত ভাইভা বোর্ডে ছিলাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সময়টা ৫ থেকে ১০মিনিটের বেশি হবে না। মনে হচ্ছিল ভাইভা বোর্ডে আমরা সবাই মিলে যেনো আলোচনা করছিলাম। এই অনুভূতিটা হয়ত আমাকে একটা ভালো মৌখিক পরীক্ষা দিতে সহায়তা করেছিল। মৌখিক পরীক্ষা অনেকটা অভিনয়ের মত; আপনি নার্ভাস হলে তা যেনো আপনার চেহারাতে ফুটে না উঠে। কোনো বিষয়ে আপনাকে উত্তেজিত করতে চাইলেও আপনি উত্তেজিত হবেন না।
যদি উত্তেজিত বা দ্বিধান্বিত হয়ে যান তাহলে আপনি প্রশ্নকর্তার ফাঁদে পা দিলেন। সব সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজের উপর বিশ্বাস রেখে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে। কিছু জিনিস আপনি নাও পারতে পারেন সেটা আপনার সমস্যা নয়। কিন্তু না পারা জিনিসটা আপনি কিভাবে সামলাচ্ছেন; সেটাই আসলে প্রশ্নকর্তা দেখতে চান। আমার বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার এই অভিজ্ঞতায় আপনারা যদি বিন্দুমাত্র উপকৃত হন তবেই আমার লেখা সার্থক। সকলের মঙ্গল কামনা করছি ও দোয়া প্রার্থনা করছি যেনো দেশও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারি।
পড়ুন: কেন প্রশাসন ক্যাডার চান?— বলেছিলাম বাবার স্বপ্ন
পড়ুন: জীবনের গল্প: বাবার সম্মান রক্ষায় এএসপি দিদার নূর
পড়ুন: ৪০তম বিসিএস: ‘কনফিউশন উত্তর’ না দাগানোই প্রিলির প্রধান কৌশল!