রাবিতে চান্স পেয়েও ভয়ে পরিবারে জানাতে পারেননি এই বিসিএস ক্যাডার
গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ফরিদা সুলতানা সোনালী। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি ৩৭তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের তার গল্প লিখেছেন- এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
জন্ম উত্তর জনপদের জেলা গাইবান্ধার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে। কৃষক বাবা আর গৃহিণী মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে চতুর্থ তিনি। লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামের এক ব্র্যাক স্কুলে। তারপর ভর্তি হন এলাকায় লেংগাবাজার বিএস উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রতিদিন বাসা থেকে স্কুলে দু’পায়ে হেঁটে যেতে প্রায় ১ঘন্টা লাগত। বর্ষাকালে কলা গাছের ভেলায় করে স্কুলে যেতেন। দুরত্ব বেশি হলেও স্কুলে অনুপস্থিতির ঘটনা ছিল হাতে গোনা। যখন নবম শ্রেণিতে উঠেন এমন সময় ফরিদার বাবার হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে বাবা কাজ কর্মে পুরোপুরিভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। সাত ছেলে মেয়েকে নিয়ে তার মা দিশেহারা হয়ে পড়েন। ফরিদার বাবার চিকিৎসা আর সংসার চালাতে গিয়ে এক সময় তার মা-ও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এমন সময় তার এসএসসি পরীক্ষা। ২০০৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে ৪.৯৪ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। পাশ করার পর স্কুলের বন্ধুরা যখন বিভিন্ন শহরে ভালো কলেজে পড়ার জন্য চলে যায় তখন নীরবে দু’ফোটা চোখের জল ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা।
এসএসসি পাশের এলাকার ধর্মপুর আব্দুল জব্বার ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন সোনালী। ২০০৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। মা-বাবার অসুস্থতা চরম পর্যায়ে তখন লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম। ঠিক তখনই বিয়ের প্রস্তাব। ছেলে লেখাপড়ার দায়িত্ব নিবেন শুনেই বিয়েতে রাজী হয়ে গেলেন। শুরু হলো জীবনের আরেক সংকটকালীন অধ্যায়। যা ভেবেছিলেন পরিবেশ পুরোপুরি তার বিপরীতে যাওয়া শুরু হলো। যৌথ পরিবারে বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের কাছে পরাজিত হলো তার স্বামী। স্বামী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও মানসিক সাপোর্ট দিয়েছিল। বিয়ের কিছু দিন পর বাবা মারা যায়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একবেলা কাজ না করলে খাবারটুকু মুখে উঠতো না। কখনও না খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। আবার কখনও পাশের বাড়ির ভাবি রাতের অন্ধকারে খাবার দিয়ে যেত তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অপরাধ লেখাপড়া করা! তারপরও ভাবতেন তাকে যেতে হবে অনেকদুর। বাঁধা পেরিয়ে তিনি জিপিএ ৪.৪০ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোন।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় এলে ভাবলেন পরীক্ষা দিবেন, চান্স পাবেন। এই চিন্তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম পূরণ করেন। কিন্তু বাধা আসে শ্বশুরবাড়ি থেকে। পরে বাবার বাসার কথা বলে রাজশাহীতে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন; তারপর চান্স হয়। কিন্তু ভয়ে সে কথা কাউকে বলতে পারেননি। তারপর রাগে, ক্ষোভে ভেবেছিলেন আর পড়ালেখা করবেন না। কিন্তু মায়ের উৎসাহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে ইংরেজিতে ভর্তি হন। বন্ধুদের সবাই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আর ফরিদা কলেজে এই ভেবে নিজেকে খুব ছোট ভাবতেন।
অর্নাসে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হওযার পর নিজের স্বর্ণের আংটি বিক্রি করে গাইবান্ধার এক মেসে ওঠেন। অনার্স ২য় বর্ষ থেকেই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। তখন থেকেই একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান, বাংলা, গণিতের বিভিন্ন রেফারেন্স বই সংগ্রহ করে পাগলের মতো পড়তে থাকেন। ৩৫তম বিসিএস প্রিলিতে উত্তীর্ণ হন। হঠাৎ নতুন প্রাণের অস্তিত্ব টের পেলেন। ফলে কখনো বসে কখনো দাঁড়িয়ে লিখে পরীক্ষা শেষ করেছেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এবার নতুন আশঙ্কা ভাইভা দিতে পারবেন কি না। সৌভাগ্যবশত নতুন সন্তান আসে ৪ ফেব্রুয়ারি আর ভাইভা পড়ে ৩ মার্চ। সিজারের পর এতদূর জার্নি ডাক্তারি নিষেধ। তা সত্বেও ভাইভায় অংশগ্রহণ করেন সোনালী। ফলাফল নন-ক্যাডার। প্রত্যেকটা লিখিত পরীক্ষায় নিজের নতুন কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ইতোমধ্যে ৩৫তম নন-ক্যাডার থেকে ‘সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা’ হিসেবে সিলেট কমিশনারেটে জয়েন করেন। ৩৭তম ভাইভা দেয়ার পর প্রত্যাশা আরো বেড়ে যায়। অবশেষে কাঙ্খিত ফলাফল। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত।
ফরিদা বলেন, আমার এই সফলতার অসামান্য অংশীদার আমার মা আর আমার স্বামী। যে আমাকে সেই কিশোরী বেলায় বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে নিয়ে এসেছিল। (পুনঃপ্রকাশিত)