৩০ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৪০

৫৭০ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসা রব্বানীর বিসিএস জয়ের গল্প!

মোঃ গোলাম রব্বানী সরদার

দারিদ্র্যতা সবসময় বাধা ছিল। কখনো কখনো বন্ধ হয়ে যেত স্বপ্ন পূরণের রাস্তা। তার পরেও হাল ছাড়েননি বাবা-মা। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ছেলের চেষ্টা। সব মিলিয়ে জয় হলো পরিশ্রম আর চেষ্টার। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য গোলাম রব্বানীর প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার গল্প লিখেছেন- এম এম মুজাহিদ উদ্দীন


যোগ্যতা থাকলে চাকরির অভাব হয়না। আর যদি কারোর স্বপ্ন থাকে, সে স্বপ্ন পূরণের একান্ত প্রচেষ্টা থাকে। তাহলে দেরিতে হলেও সে স্বপ্ন পুরণ হয়- কথাগুলো বলছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ৩৭তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মোঃ গোলাম রব্বানী সরদার। জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে তিনি আজকে তার স্বপ্নকে ছুঁতে পেরেছেন।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুরের হাকিমপুর (হিলি) উপজেলার বোয়ালদাড় গ্রামে তার বেড়ে উঠা। বাবা মোঃ মোসলেম উদ্দীন সরদার একজন কৃষক। আর মা মোছাঃ আক্তারা বিবি গৃহিণী। কৃষক বাবার অভাব অনটনের সংসারে ছোট বেলায় তেমন ভালো শিক্ষার্থী ছিলেন না। কিন্তু হঠাৎ করে অষ্টম শ্রেণীতে একটা ঘটনার কারণে জীবনের মোড় কিছুটা ঘুরে যায়। কী ছিল ঘটনা?

জানতে চাইলে গোলাম রব্বানী বলেন, ‘বোয়ালদাড় দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাসে একদিন আঃ বারী স্যার একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তরটা কেউ দিতে পারছেনা; তখন আমি দাড়িয়ে সেই প্রশ্নের উত্তরটা দিয়েছিলাম। তখন স্যার আমার প্রশংসা করে বলেছিলেন, গোলাম রব্বানী তো ভালো স্টুডেন্ট হয়ে গেছে। স্যারের সেদিনের সেই কথা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমি নতুন উদ্যেমে পড়ালেখা শুরু করেছিলাম। মা-বা সব সময় অনুপ্রেরণা দিত। সেবার বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য নির্বাচিত ও হয়েছিলাম। বৃত্তি না পেলেও পড়ালেখার উদ্যেম আর থামায়নি।”

এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে জিপিএ ৪.১৩ পেয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোন। তারপর ভর্তি হন বিরামপুর সরকারী কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেও ইংরেজি বিষয়ে আসক্তি তৈরি হয়; তাই উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর স্বপ্ন দেখেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতির জন্য কোচিং করার টাকাও ছিল না। ভর্তি প্রস্তুতির পুরাতন বই সংগ্রহ করে বাড়িতে বসেই প্রস্তুতি শুরু করেন। তারপর ঢাকায় পাড়ি জমান।

এই স্বপ্নজয়ী বলেন, ‘‘বাবার কাছ থেকে ৫৭০ টাকা নিয়ে প্রথমবারের মত ঢাকায় আসলাম। ঢাকায় আসার পর থেকেই জীবনকে জানতে শিখলাম। বাস্তবতা বুঝতে শিখলাম। ঢাকা ক্যান্টমেন্টের পাশে পরিচিত এক ভাইয়ের মেসে উঠলাম। ৫৭০ টাকা থেকে মেসের খরচসহ অনান্য খরচ বাবদ টাকা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষার ফরম কেনার টাকা ছিল না। মেসের এক ভাই আমাকে ৫০০ টাকা ধার দেন। সেই টাকা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম কিনি। কিন্তু প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলো না।”

গোলাম রব্বানীর মন ভেঙে গেলেও থেমে থাকেননি। শুরু করেন টিউশনি; নিতে থাকেন নতুন করে ভর্তি প্রস্তুতি। দ্বিতীয় বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে পড়ার সুযোগ পান। প্রথম শ্রেণীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল করেন। তবে মনে স্বপ্ন ছিল একদিন ভালো কিছু করবেন। সব কষ্ট দূর হবে। বাবা-মার বুক গর্বে ভরে যাবে। হয়েছেও তা-ই।

গোলাম রব্বানী স্নাতকোত্তরে পড়াকালীনই আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে সিনিয়র ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তারপর আর থেমে থাকেননি। একের পর এক চাকরি পেয়েছেন। প্রথমবার বিসিএস নন ক্যাডারে প্রাইমারির প্রধান শিক্ষক, সিলেট ক্যাডেট কলেজে প্রভাষক, পরে ঠাকুরগাঁও-এ উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত।

রব্বানী জানান, উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ইংলিশে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন। আবার স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকতার পাশাপাশি টিউশনি করেছেন। এগুলো বিসিএসে বেশ কাজে দিয়েছে। ধৈর্য ধরে নিয়মিত বাসায় বসে মডেল টেস্ট দিতেন। চাকরির পাশাপাশি যতটুকু সময় পেতেন সেই সময়টুকু পড়তেন। যেখানেই যেতেন, সেখানেই বই নিয়ে যেতেন। এভাবে লেগে থাকার ফলে বিসিএস পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত সফলতা এসেছে। এখন শুধুই প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে জনগণের সেবা করার পালা।