জনসংখ্যা বোনাসের যুগে বেড়েছে বেকারত্ব
দেশের তরুণদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নানা সূচকে বাংলাদেশ চোখে পড়ার মতো সাফল্য দেখালেও বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি উদ্বেগ তৈরি করছে। ফলে যোগ্যতা থাকা স্বত্ত্বেও দেশের উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে বেকার থাকতে হচ্ছে। তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। যার মধ্যে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, দেশের মোট জন্যসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশই বেকার। এছাড়া উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে ১০ শতাংশ তরুণ বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন।
দেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার সিংহভাগই কর্মক্ষম তরুণ। একটি জাতির জীবনচক্রে এমন সময় কমই আসে। সেই পপুলেশন ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা বোনাসকালে বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মহীন থাকা কিংবা মানহীন কাজে নিয়োজিত থাকা জাতীয় উন্নতির গতিকেও শ্লথ করে দিচ্ছে।
অন্যদিকে গুণগত কর্মসংস্থানের সংকটও প্রকট আকার ধারণ করায় বেকারত্বের এই ঘোড়া দিন দিন লাগাম ছাড়া হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপকহারে শিল্পের প্রসার ঘটেছিল। কিন্ত এই খাতের শ্রমবাজার সেই অর্থে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ লাভ করেনি। ফলে গড়ে উঠেনি গুণগত কর্মসংস্থান কিংবা স্থায়ী কাজের সুযোগ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি প্রতিবেদন বলেছে, বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকে। স্থায়ী কর্মসংস্থান না থাকায় বিশাল এই জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের ঝুঁকি প্রবল।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। ২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ও ভুটান এই হার কমিয়ে এনেছে। স্থিতিশীল রয়েছে ভারতে। তবে বাড়ছে বাংলাদেশে। আইএলও’র হিসাব অনুযায়ী, ২০০০ সালে দেশে সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালে তা ৩ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ওই বছর দেশে ২০ লাখ লোক বেকার ছিল। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ২৪ লাখে বৃদ্ধি পায়। আবার ২০১৬ সালে এসে তা ২৮ লাখে উঠে। আগামী বছর এ সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের কোটায় ঠেকতে পারে।
অন্যদিকে, সাধারণ দৃষ্টিকোন থেকে উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই চিত্র উল্টো। ২০১৭ সালে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর পার হতে না পারা ১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ বেকার ছিল; যেখানে প্রাথমিক শেষ করাদের মধ্যে ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আবার মাধ্যমিক শেষ করা মানুষদের মাঝে মোট ৮ শতাংশ বেকার ছিল। তথ্য বলছে, উচ্চ শিক্ষিতদের মাঝে এই হার সবচেয়ে বেশি। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করা তরুণদের ১০ দশমিক ৭ শতাংশই বেকার। আইএলও’র আরেকটি প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
যেসব কারণে বাড়ছে বেকারত্ব
দেশের বেসরকারি খাতগুলোতে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগ। এর ফলে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। এরপরও বেসরকারি খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরিও কম। চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে অনিশ্চয়তা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা শিক্ষাগ্রহণ শেষে সরাসরি চাকরির বাজারে ঢুকে পড়ে। কোন ধরণের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করায় এরা নিজেদেরকে শ্রমবাজারে উপযোগী করে তুলতে পারে না। জানা যায়, সরকারি চাকরিতে প্রায় তিন লাখ পদ খালি আছে। সরকারের যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এসব নিয়োগ আটকে আছে।
বেসরকারি খাতে বেশির ভাগ সময়ই উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করা হয়। সরকারি খাতে বিদেশি শ্রমিকের আমদানি করার প্রবণতা রয়েছে। এর ফলে দেশীয় শ্রমিক ও সম্ভাবনাময় জনশক্তি কাজের সুযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছে। যুগোপযোগী শিক্ষার অভাবকেও বেকারত্বের অন্যতম একটি কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। মানসম্মত শিক্ষার ঘাটতি, কর্মমূখী শিক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতাও বেকারত্বকে মহামারী রূপ দিয়েছে।
অনেক চাকরিপ্রার্থী অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলগুলোও চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করে থাকে। যেন নেতার আশীর্বাদ পেলেই সোনার হরিণ নামক চাকরি মিলবে। সরকারি চাকরির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষ করেই বিসিএস প্রস্ততি শুরু করে দিচ্ছে। এতে অন্যান্য খাতে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে বিসিএসে অনিশ্চয়তা থাকার ফলে এখানেও বেকারত্ব ঝুঁকি প্রবল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উল্লেখিত সংখ্যা দিয়ে দেশের বেকারত্ব মাপা সম্ভব নয়। এসব হিসাবের তুলনায় দেশে বেকারত্বের সংখ্যা অনেক বেশি। তিনি বলেন, বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা যায়, আয়বৈষম্য অনেক বেশি। সেই বৈষম্য ধনী-দরিদ্রের। বৈষম্যের বড় কারণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও উৎপাদন খাতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
যে পথে সমাধান
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ে তরুণদের মাঝে সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চ বেতন এবং বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধার কারণে উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা সরকারি চাকরির প্রতি বেশি পরিমাণে ঝুঁকে পড়েছে। ফার্মেসিতে পড়া একজন শিক্ষার্থীও মেজিস্ট্রেট হতে চায়। দর্শনের ছাত্র ব্যাংকের কর্মকর্তা হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। ফলে পর্যাপ্ত পরিমান বিষয়ভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো দখল করে নিচ্ছে বিদেশি শ্রমবাজার।
তাদের মত, বেকারত্বের অভিশাপ হতে বর্তমান প্রজন্মকে রক্ষা করেতে সরকারের যথাযথ সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। উৎপাদনমুখী শ্রমবাজারের মাধ্যমে ব্যাপকহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বিশিষ্টজনদের ভাষ্য, বেকারত্ব দূর করতে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, আমরা আমাদের দেশে দক্ষ বা শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলতে পারছি না। এটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থারও দুর্বলতা। দেশীয় উচ্চশিক্ষিতদের ধরে রাখতে তাদেরকে পর্যাপ্ত মূল্যায়ণ করতে হবে। তাহলে তাদের বিদেশ চলে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব হবে।
তিনি মনে করেন, দেশে গুণগত মানের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে ভালো কাজের ক্ষেত্রগুলোকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত রূপরেখা বাস্তবায়ন ছাড়া ভালো কাজের সুযোগ সৃষ্টি ভবিষ্যতে আরও দুরূহ হয়ে উঠতে পারে বলেও মত দেন মোস্তফা আজাদ চৌধুরী।