কষ্টের জীবনে স্বপ্নজয়ী ওরা
একজনের দুটো হাতই নেই তো আরেকজন জন্মান্ধ। স্বাভাবিক চলাফেরা কিংবা কলম ধরার সামর্থ্য—কোনটাই ওদের নেই। শুধু তাই নয়, দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে না পাওয়া শিশুও আছে এই কাতারে। কিন্তু স্বপ্ন যাদের আকাশ ছোঁয়ার; সেইসব মানুষদের ‘প্রতিবন্ধিত্ব’ নিয়ে ভাবলে চলে? শাফিয়া, মোবার, আসিব কিংবা কাওছাররাও ভাবেনি। তাইতো তারা অগণিত বাঁধা-বিঘ্নতাকে জয় করে এগিয়ে চলেছেন। পাস করেছেন শিক্ষাজীবনের স্বীকৃত ধাপ, পিইসি, জেএসসি।
প্রতিবন্ধীতা বোঝে না শাফিয়া
হাতের কনুই দিয়ে লিখে জিপিএ ৪ দশমিক ২৯ পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে শাফিয়া। তার ইচ্ছা, লেখাপড়া শেষ করে একজন শিক্ষক হবে। শিক্ষক হয়ে সে দেখিয়ে দিতে চায়, প্রতিবন্ধকতা কোনো সমস্যা নয়। প্রতিবন্ধী মানুষ অনেক কিছুই জয় করতে পারে।
জানা যায়, শাফিয়ার বাবা মো. আজমল হোসেন চাকরি করেন সিলেট নগরীর কুষ্ঠ হাসপাতালে। তার মা হোসনে আরা খাতুন চাকরি করেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তারা দু'জনেই পেশায় নার্স। তারা জানান, ২০০৪ সালে তাদের কোলজুড়ে জন্ম নেয় শিশু শাফিয়া। তখন থেকেই হাত নেই, পা-ও নেই তার। শিশুর এমন অবস্থা দেখেও দমে যাননি আজমল ও হোসনে আরা দম্পতি। তারা তাকে সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে ওঠার স্বপ্ন দেখান। মা-বাবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পিছপা হয়নি শাফিয়া। বাগবাড়ি পিডিবি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিইসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৪.৭৫ পায়। আর এবার জেএসসি পরীক্ষায় পেল ৪.২৯।
বাবা আজমল জানান, পড়াশোনায় আগ্রহ দেখে অনেক সময় ইচ্ছে হয়, বিদেশে নিয়ে মেয়েকে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু সাধ থাকলেও সেই সামর্থ্য যে তার নেই।
কলম কামড়ে লিখে পাস করল মোবারক
মুখ দিয়ে কলম ধরে লিখে জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের প্রতিবন্ধী মোবারক হোসেন।
মোবারক কাশিপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৩.২১ পেয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জায়দুল হক বলেন, মোবারক হোসেন জন্মগত প্রতিবন্ধী। পড়াশোনার প্রতি তার রয়েছে প্রবল আগ্রহ। ক্রিকেটেও সে পারদর্শী। তার সফলতায় আমরা খুবই খুশি। মোবারক হোসেন বলেন, পড়াশোনা শেষে শিক্ষক হতে চাই । আমি সবার দোয়া এবং সহযোগিতা চাই।
জানা যায়, উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের হতদরিদ্র এমদাদুল হকের ছেলে মোবারক হোসেন কাশিপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তার পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল ফুলবাড়ী বালিকা পাই উচ্চ বিদ্যালয়। নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষায় তাকে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ৩০ মিনিট বেশি দেয়া হয়েছিল।
অন্ধত্বকে জয় করে ১৩ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সাফল্য
পাবনা শহীদ এম মনসুর আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও চরবলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া সেই ১৩ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্য দেখিয়েছে। শ্রুতি লেখকের সহায়তায় অন্য সব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা এই সফলতা অর্জন করে। শিক্ষার্থীরা পাবনা মানবকল্যাণ ট্রাস্টে পড়াশোনা করেন বলে জানা গেছে।
প্রতিবন্ধী লোকমান শেখ বলেন, অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রুতি লেখকের সহায়তায় একই প্রশ্নে তাদের পরীক্ষা দিতে হয়। অনেক সময় তারা সঠিক বলে দিলেও শ্রুতি লেখক লিখতে ভুল করে বসে। এতে নম্বর কমে যায়।
জানা যায়, পরীক্ষায় ইর্ষণীয় ফল অর্জনকারী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা হলেন- নওগাঁর আমিনুল ইসলামের ছেলে মো. কাওসার ইসলাম (জিপিএ ৪.৯), শরীয়তপুরের শাহীন আলম (জিপিএ ৪.৭), পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার আব্দুস সাত্তারের ছেলে মো. আব্দুস সবুর (জিপিএ ৪.৬৪), কুড়িগ্রামের মাসুদ রানা (জিপিএ ৪.৪৩), চাঁপাইনবাবগঞ্জের আনসার আলীর ছেলে মোশারফ হোসেন (জিপিএ ৪.৩৬), পাবনা সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নের মো. চাঁদ আলী শেখের ছেলে আলামিন শেখ (জিপিএ ৪.২৯), বগুড়ার জাকির হোসেনের ছেলে হযরত আলী (৪.২১), কুমিল্লার নিমাই চন্দ্র দের ছেলে বাপ্পি চন্দ্র দে (জিপিএ ৪.২১), নাটোরের সেলিম মৃধার ছেলে আমিরুল ইসলাম মৃধা (জিপিএ ৪.২১), পাবনার সুজানগর উপজেলার আজাদ শেখের ছেলে লোকমান হোসেন শেখ (জিপিএ ৪.১৪), পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কুদ্দুস মিয়ার ছেলে মো. আব্দুল্লাহ মিয়া (জিপিএ ৩.৯৩), রাজশাহীর মো. জামাল উদ্দিনের ছেলে রুবেল ইসলাম (জিপিএ ৩.৭১) ও কুমিল্লার রাসেল আহমেদ (জিপিএ ৩.৫৭)।
পাবনা মানবকল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন বলেন, অন্ধদের লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজন ব্রেইল পদ্ধতি। অথচ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ সুযোগ নেই। এখন পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন শ্রুতি লেখকের। দরিদ্র এসব অন্ধদের শ্রুতি লেখকদের সম্মানী তো দূরের কথা লেখাপড়ার করার ন্যূনতম আর্থিক ব্যয় নির্বাহ করারও সক্ষমতা নেই। তারপরেও থেমে থাকেনি এসব সংগ্রামী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর শিক্ষাজীবন।
ঝালমুড়ি বিক্রেতা আসিবও পেয়েছে জিপিএ-৫
আসিবের বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী, মা গৃহিণী। টানাপোড়েনের সংসারে যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আর এসব মেনে নিয়েই পড়ালেখা করেন আসিব। পাশাপাশি পরিবারকে খাওয়াতে চালান ঝালমুড়ি বিক্রির ব্যবসা। অন্যসব কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীর মত সেও এবার পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। প্রকাশিত পিএসসি ফলে জিপিএ-৫ পেয়েছে আসিব।
যদিও জিপিএ-৫ পাওয়ার গল্পটা আরেকটু আবেগি। আজ ফল প্রকাশের দিনে অন্য সবার মত আসিবের মনেও সখ জেগেছিল সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর। সে কারণেই আত্মবিশ্বাসী আসিব শুরু করেন ঝালমুড়ি বিক্রি। সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য জমান ১১০ টাকা। পূরণ করেন মিষ্টি খাওয়ানোর ইচ্ছা। আসিবের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়। ব্রাহ্মনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সে। তার বাবার নাম মো. মুসলিম। আসিবের স্বপ্ন আকাশছোঁয়ার। হতে চায় পাইলট। উড়ে বেড়াতে চায় সারা বিশ্ব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধী মানুষেরা অপ্রতিবন্ধীদের তুলনায় সাধারণত বেশি মেধাবী। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের হাতে তৈরি অনেক কুটির শিল্প খুবই সুনিপুন। শুধু তাই নয়, মেধার প্রশ্নেও তারা আপোসহীন থাকে। তাদের সুরক্ষায় সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা প্রদানে এগিয়ে আসা উচিত।
আর এসব শিক্ষার্থীদের চাওয়া, তারা অনেক সংগ্রাম, অনেক প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে এই পর্যায়ে এসেছেন। সর্বোচ্চ সহযোগিতার জন্য সরকারের উচিত— প্রতিবন্ধী এসব শিক্ষার্থীদের দিকে নজর দেয়া, তাদের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান খুলে আলাদাভাবে বাজেট বরাদ্দ দেয়া।