১০ নভেম্বর ২০১৮, ১৮:১৩

উন্নয়নের নেপথ্য নায়ক স্বেচ্ছাসেবী তারুণ্য

  © টিডিসি ফটো

রাজধানীর পরীবাগ ও সেগুনবাগিচার রাস্তায় বসে ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের নিয়মিত লেখাপড়া করতে দেখা যায়। অথচ ঢাকা পৃথিবীর ব্যয়বহুল শহরগুলোর একটি। উন্নত অবকাঠামো, পাকা ও আধাপাকা হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। কিন্তু সেখানে রাস্তায় বসে লেখাপড়া করতে হবে কেন? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতে পারে।

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, সমাজের বিশেষ কিছু মানুষের অার্থিক উন্নয়নের সাথে বৈষম্যও বেড়েছে সমানভাবে। থাকার জয়গা নেই অনেক মানুষের। পরিবার হারিয়ে পথে পথে দিনযাপন করছেন অনেক শিশু, কিশোর ও বৃদ্ধ। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শিশু কিশোর। শিক্ষার অভাবে জড়িয়ে পড়ছে ছিনতাই, মাদক, চুরিসহ নানা ছোট খাট অপরাধে।

সমাজের এসব ঠিকানা ও আশ্রয়হীন শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে, আলোকিত করে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে আনতে ”এভারগ্রীন জুম বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠনের নামে কাজ করছে কিছু স্বেচ্ছাসেবী তরুণ। নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে পথশিশু আর সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বই-খাতা কিনে দিচ্ছে এসব তরুণরাই। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পাঠদানের ব্যবস্থা করার সামর্থ না থাকায় রাস্তাকেই পাঠশালা বানিয়েছে তারা।

এভারগ্রীন জুম বাংলাদেদেশের প্রতিষ্ঠাতা এস টি শাহীন প্রধান। এই কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকা কলেজে ভর্তির পর থেকে আমি বিভিন্ন সংগঠনের সাথে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছি। এসব কাজ করার সময় পথশিশু এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অমানবিক জীবন আমাকে সব সময় কষ্ট দিতো। তাদের অবস্থাকে কিভাবে শিক্ষার অধিকার দেয়া যায়, সেই চিন্তা থেকেই পথ পাঠশালা চালু করি। এখন রাজধানীতে ছয়টি স্কুল রয়েছে যেখানে আমাদের নিয়মিত ২৫জন স্বেচ্ছাসেবী পাঠদান করেন।

চাঁদপুরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছে তারুণ্যের অগ্রদূত

শুধু এভারগ্রীন জুম বাংলাদেশই নয়, দেশের সামগ্রীক উন্নয়নে নানাভাবে কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার। যার অধিকাংশই তরুণ। যারা নিজেরা দেশের কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী।

সরকারের এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর (এনজিওএবি) ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট ২ হাজার ২০৩ টি এনজিও রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ এসব এনজিওর সেবা পেয়েছে।

শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র, শোষণ, বৈষম্য এবং সহিংসতামুক্ত সমাজ বির্নিমানে ২০০৭ সাল থেকে কাজ করছে দেশের আরেকটি এনজিও জাগো ফাউন্ডেশন। একটি সাদা বোর্ড, মার্কার, একটি ছোট মাদুর ও ১৭জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে জাগো ফাউন্ডেশন স্কুল। শুরুর দিকে এতো কিছু চিন্তা করা হয়নি। প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে তখন কাজ শুরু করা। বর্তমানের ফাউন্ডেশনের ১২টি স্কুলের আওতায় ৩ হাজার ছাত্র ছাত্রী রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে যুক্ত থেকে কাজ করছে প্রায় ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী।

চাঁদপুরের স্কুল থেকে ঝরে যাওয়া কিংবা একেবারেই স্কুলে যেতে না পারা শিশুদেরকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘তারুণ্যের অগ্রদূত’। পাশাপাশি এসব শিশু শিক্ষার্থীদেরকে পৃথকভাবে পাঠদান করা হচ্ছে। তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় বিনা খরচে খাবার ও চিকিৎসাসেবা। বিভিন্ন উপলক্ষে দেয়া হয় নতুন জামাকাপড়। 

সম্প্রতি কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তবে প্রাকৃতিক এই ঝুঁকি নতুন উদ্যোক্তা তৈরীর জন্য বড় একটি সম্ভাবনাও। যা একজনকে অন্যজনের সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কাজ করে।

দেশের অন্যতম প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী রওনক জাহানকে উদ্ধৃত করে সংস্থাটির তার প্রতিবেদনে বলে, ১৯৭১ সালের সংঘটিত যুদ্ধের একটি প্রভাব মানুষের ওপর পড়েছে। ওই যুদ্ধ সমাজের পুরনো প্রথা ও রীতিকে দুর্বল করেছে। মানুষকে নিজের পায়ে দাড়াতে শিখিয়েছে। 

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ এনজিও ব্র্যাক এবং ক্ষুদ্র ঋণ কার্যকম পরিচালনা করে নোবেলজয়ী গ্রামীন ব্যাংকের সূচনাও ১৯৭০’র বন্যা , যুদ্ধ পরবর্তী মানুষের দুর্দশা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, স্যার ফজলে হাসান আবেদকে আলোকবর্তিকা মেনে পরস্পরের বিপদে সহযোগিতা, স্বেচ্ছা শ্রম, আর নানা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের তরুণরা। গত বছর সিলেটের বন্যায় ঘর-বাড়ি ও ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া মানুষকে টেনে তুলতে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার তরুণ কাজ করেছে। এখনও সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ে কাজ করছে অনেক তরুণ। 

এই বাংলাদেশের তরুণরা তাদের স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম শুধু দেশের মানুষের জন্যই সীমাবদ্ধ রাখেনি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসনসহ নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এবং কিশোর-কিশোরীরা। বর্তমানে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে কর্মরত ১৫১ এনজিও’র সাথে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে।