কৃৃষকের ছেলের বাড়িতে ল্যাম্বরগিনি-বিএমডাব্লিউ, দুবাইয়ে ক্রুজে বিয়ে, অতপর...
উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের একটি ছোট গ্রামের বাসিন্দা অনুরাগ দ্বিবেদীর বাবা একজন কৃষক। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। তবে পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটার হওয়া হয়নি অনুরাগের।
এর পর ভিন্ন পথে এগোন তিনি। বর্তমানে জনপ্রিয় এক ইউটিউবার অনুরাগ দ্বিবেদীর বাড়িতে বৃহস্পতিবার তল্লাশি চালিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তল্লাশির সময় তার জীবনযাত্রার ব্যাপ্তি দেখে কার্যত বিস্মিত হন তদন্তকারীরা। বিশেষ করে গ্যারাজে রাখা ল্যাম্বরগিনি উরুস, বিএমডব্লিউ জেড৪, মার্সিডিজ–বেঞ্জসহ একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি নজর কাড়ে।
ইডি সূত্রে জানা গেছে, বেটিং ও জুয়া–সংক্রান্ত অ্যাপের একটি মামলার তদন্তে অনুরাগের নাম উঠে আসে। তদন্তে জুয়া নেটওয়ার্ক থেকে আর্থিক আদান–প্রদান এবং অবৈধ আয়ের হদিস মেলে। অভিযোগ, অনলাইন বেটিং ও জুয়ার অ্যাপ থেকে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন অনুরাগ। সেই মামলার সূত্র ধরেই বৃহস্পতিবার তার উন্নাওয়ের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
তদন্তে অনুরাগের বাড়ি থেকে নামীদামি সামগ্রী ও গাড়ির তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে কোনো বৈধ লেনদেন ছাড়াই বিপুল অর্থ জমার তথ্য মিলেছে। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ ব্যবহার করে ভারতের বাইরে, মূলত দুবাইয়ে সম্পত্তি কেনার বিষয়ও উঠে এসেছে তদন্তে।
সূত্রের খবর, অনুরাগের আয়ের বড় একটি অংশ এসেছে স্কাই এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন জুয়া অ্যাপ থেকে। এসব অ্যাপে অনলাইন বেটিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করা হয়, যা ভারতে অবৈধ। ইডির কর্মকর্তাদের দাবি, ওই অ্যাপগুলো থেকে পাওয়া অর্থ বিভিন্ন উপায়ে অনুরাগের কাছে পৌঁছাত। পরে সেই অর্থ দিয়ে কেনা হতো বিলাসবহুল গাড়ি ও অন্যান্য দামি সামগ্রী। অবৈধ আয়ে কেনা সম্পত্তি গোপন করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, অবৈধ অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্মের প্রচারে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন অনুরাগ। এসব অ্যাপের মাধ্যমে মানুষকে প্রলুব্ধ করতে প্রচারমূলক ভিডিও তৈরি ও প্রচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বেটিং ও জুয়া অ্যাপ থেকে অনুরাগ মোট কত অর্থ উপার্জন করেছেন এবং সেই অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত চালাচ্ছে ইডি। একই সঙ্গে এই চক্রে অনুরাগ ছাড়া আর কারা জড়িত, সেটিও যাচাই করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সোনু কুমার ঠাকুর ও বিশাল ভরদ্বাজ—এই দুই ব্যক্তির নাম তদন্তে উঠে এসেছে। অনলাইন বেটিং ও জুয়ার অর্থ লেনদেনে বেনামি ব্যাংক হিসাব, টেলিগ্রাম চ্যানেল ও অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় বেআইনি আর্থিক লেনদেন প্রতিরোধ আইনে (পিএমএলএ) মামলা দায়ের করেছে ইডি।
অনুরাগ লক্ষ্মীনাথ দ্বিবেদী নামেও পরিচিত অনুরাগ একজন জনপ্রিয় ভারতীয় ইউটিউবার। ক্রিকেট বিশ্লেষক এবং ‘ড্রিম১১’-এর মতো ফ্যান্টাসি ক্রিকেট লিগের বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তিনি পরিচিত। বিভিন্ন ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে সমাজমাধ্যমে ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন তিনি।
২০১৭ সালে মাত্র ৩০০ টাকা দিয়ে ফ্যান্টাসি ক্রিকেট খেলা শুরু করেন অনুরাগ। ২০১৮ সালে চালু করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেল। সেখানে ম্যাচ প্রিভিউ, ফ্যান্টাসি টিপস ও দল গঠন নিয়ে মতামত দিতেন তিনি। বিনা মূল্যে পরামর্শও দেওয়া হতো। অনুরাগের দাবি, ফ্যান্টাসি ক্রিকেট প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা আয় করেছেন। এ দাবির পর তার অনুরাগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।
বর্তমানে তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার প্রায় ৫০ লাখ। ফ্যান্টাসি ক্রিকেট নিয়ে কনটেন্ট নির্মাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম বড় নাম। ইউটিউবের পাশাপাশি ইনস্টাগ্রামে তার অনুসারী প্রায় ২৪ লাখ। টেলিগ্রাম, ফেসবুক ও এক্সেও তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সমাজমাধ্যমে নিজেকে ‘ফ্যান্টাসি ক্রিকেটের মুখ’ হিসেবে পরিচয় দেন তিনি।
তবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি একাধিকবার সমালোচনার মুখেও পড়েছেন অনুরাগ। তার আয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। অভিযোগ রয়েছে, ইউটিউব চ্যানেলের পাশাপাশি তিনি বেটিং ও জুয়া অ্যাপের প্রচার চালাতেন। তার প্রভাবেই বিপুলসংখ্যক মানুষ এসব অ্যাপে যুক্ত হন, যা অবৈধ কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করেছে বলে ইডির দাবি। অবৈধ আয়ের মাধ্যমেই বর্তমানে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অনুরাগ—এমন অভিযোগও রয়েছে।
অনুরাগের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার প্রতিফলন দেখা যায় তার সম্পদে। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ল্যাম্বরগিনি উরুস ছাড়াও তার সংগ্রহে রয়েছে বিএমডব্লিউ জেড৪, মার্সিডিজ–বেঞ্জ ই–ক্লাস ও ল্যান্ড রোভার ডিফেন্ডারের মতো গাড়ি।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অনুরাগ দাবি করেছিলেন, লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের এক সদস্যের কাছ থেকে তিনি খুনের হুমকি পেয়েছেন। এ নিয়ে তিনি পুলিশের কাছেও গিয়েছিলেন বলে দাবি করেন।
গত মাসে, অর্থাৎ ২০২৫ সালের নভেম্বরে অনুরাগের বিয়ে হয়। দুবাইয়ের একটি বিলাসবহুল ক্রুজে অনুষ্ঠিত হয় সেই বিয়ের অনুষ্ঠান। ওই আয়োজন ও বিলাসিতা জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রশ্ন ওঠে, একজন সাধারণ ইউটিউবার কীভাবে এমন ব্যয়বহুল বিয়ের আয়োজন করলেন।
এই বিষয়টিও নজরে আসে ইডির। এর পরই ফ্যান্টাসি স্পোর্টস প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আয়ের উৎস অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু হয়। সেই তদন্তের অংশ হিসেবেই বৃহস্পতিবার অনুরাগের উন্নাওয়ের বাসভবনে অভিযান চালানো হয়। [সূত্র: আনন্দবাজার]