৫ ভূমিকম্পের ৩টি একই সময়ে, বাকি দুটির ব্যবধানও ১ সেকেন্ড, ব্যাখ্যা কী?
পরপর তিন দিন সকাল সাড়ে ১০টার পর ৪ মিনিটের ব্যবধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অঞ্চলে তিনটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বাংলাদেশে আরও দুটিসহ এই অঞ্চলে মোট ৫টি ভূমিকম্প হয়। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে প্রথম ভূমিকম্পটি নরসিংদীর মাধবদীতে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রায় অনুভূত হয়। দ্বিতীয়টি তার পরের দিন শনিবার ১০ টা ৩৬ মিনিটে নরসিংদীর পলাশে ৩.৩ এবং আজ রবিবার (২৩ নভেম্বর) ১০ টা ৩৯ মিনিটে মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূলে ৫.৩ মাত্রায় ভূকম্পন অনুভূত হয়। শুধু তাই নয়, বাকি দুটি ভূমিকম্পও এক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে হয়েছে। সময় ছিল শনিবার (২২ নভেম্বর) ৬ টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড ও ৬ টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ড।
এদিকে টানা তিন দিন এমন সময়ে ভূমিকম্প ও বাকি দুটিও একই সময়ে হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেছে, এর পেঁছনে বৈজ্ঞানিক কোনও ব্যাখ্যা আছে কি না? একই সময়ে আবার ভূমিকম্প হবে কি না এমন প্রশ্নও রয়েছে অনেকের মনে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। প্রায় একই সময়ে তিনটি ভূমিকম্পের বৈজ্ঞানিক কোনও ব্যাখ্যা আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রায় একই সময়ে তিনটি ভূমিকম্পের আসলে কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটা কাকতালীয়ভাবেও হতে পারে। কারণ, ভূমিকম্পের একেকটি প্লেট একেক স্থানে অবস্থান করছে। সময় হিসাব করে এভাবে ভূমিকম্প হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশে চারটি ভূমিকম্পের পরও আর ভূমিকম্পের সম্ভাবনা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমনটি আসলে নিশ্চিত করে বলা যায় না। একটা বড় ভূমিকম্পের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরও ছোট ভূমিকম্প হতে পারে। এর সংখ্যাটা অনেক বেশিও হতে পারে আবার কমও হতে পারে।
এর মধ্যে পরপর ভূমিকম্পের ফলে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক ৩ প্লেট ও ছয় ফল্ট নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে উঠেছে। এগুলোর কারণেই মূলত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিকম্প হচ্ছে। আসুন এগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত জেনেই নিই-
তথ্যমতে, বাংলাদেশ মূলত তিনটি বড় প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত-
ক. ইন্ডিয়ান প্লেট: বাংলাদেশের বৃহৎ অংশ এই প্লেটের পূর্ব-উত্তর অংশে। উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেট এবং পূর্বে বার্মা প্লেটের সাথে সংঘর্ষ ঘটায়।
খ. ইউরেশিয়ান প্লেট: হিমালয় অঞ্চলের ওপরে, বাংলাদেশের উত্তরে। ইন্ডিয়ান প্লেটের সাথে সংঘর্ষে হিমালয় ও উত্তরাঞ্চলের ভূকম্পের উৎস সৃষ্টি করে।
গ. বার্মা প্লেট (Burma Microplate): বাংলাদেশের পূর্বদিকে মিয়ানমার অঞ্চলে এর অবস্থান। এখানেই সবচেয়ে বিপজ্জনক ইন্দো-বার্মা মেগাথ্রাস্ট রয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান সক্রিয় ফল্টসমূহের মধ্যে ভেতরে ও সীমান্ত বরাবর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল্টগুলো হলো-
১. ডাউকি ফল্ট (Dauki Fault): এর অবস্থান সিলেটে মেঘালয়ের পাদদেশ। এর প্রকৃতি হলো বড় থ্রাস্ট ফল্ট। বড় ঝুঁকি হলো রিখটার স্কেলে ৭–৮ পর্যন্ত বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা। এর প্রভাবিত জেলাগুলো হলো সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও মৌলভীবাজার।
২. মধুপুর বা মধবপুর ফল্ট (Madhupur Fault): এটির অবস্থান টাঙ্গাইল–ময়মনসিংহ–গাজীপুর অঞ্চলের পশ্চিমে। এর ঝুঁকি হলো এম ৬.৫–৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় শক্তভাবে অনুভূত হবে। প্রভাবিত জেলাগুলো হলো টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা।
৩. চট্টগ্রাম ফোল্ড বেল্ট ফল্টসমূহ: অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চল। এর ধরন হলো বহু সক্রিয় ফল্ট—ক্রাস্টাল কম্প্রেশন। আর প্রভাবিত জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার।
৪. ইন্দো-বার্মা মেগাথ্রাস্ট (Subduction Zone): বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পূর্বে এটির অবস্থান। ধরন হলো বড় সাবডাকশন ফল্ট—এশিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনকগুলোর একটি। এর ঝুঁকি হলো এম ৮.৫ এর বেশি হওয়া সম্ভাবনা। প্রভাবিত জেলা হলো কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
৫. শিলং প্লাটো সীমান্ত ফল্ট (Shillong Plateau Boundary Faults): এটির অবস্থান ভারতের শিলং–মেঘালয়ের উচ্চভূমি। ঝুঁকি হলো ১৮৯৭ সালের মতো বড় ভূমিকম্প পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা। প্রভাবিত জেলা হলো সিলেট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহ।
৬. তিস্তা লাইনামেন্ট, প্লায়া-গঙ্গা লাইনামেন্ট: এটির অবস্থান উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, ঝুঁকিও তুলনামূলক কম। প্রভাবিত জেলা হলো রংপুর, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও।
ঝুঁকিপূর্ণ ২৪ জেলা
সামগ্রিক সম্মিলিত ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলার মধ্যে প্রথম স্তরে (অত্যন্ত উচ্চ) রয়েছে, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও গাজীপুর।
দ্বিতীয় স্তরের ঝুঁকিতে (উচ্চ) আছে মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, শেরপুর, সুনামগঞ্জ, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী ও ফেনী। তৃতীয় স্তরের ঝুঁকিতে (মাঝারি) আছে রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও বরিশাল।