২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১২

নামের অর্থের মতই কি সুন্দর হবে ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’?

প্রতীকি ছবি  © টিডিসি ছবি

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি আরও শক্তি সঞ্চয় করে ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থায়’ পরিণত হয়েছে। এতে সাগরে উত্তাল অবস্থা বিরাজ করছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সমুদ্র উপকূল ও এর আশপাশের এলাকায় ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত জারি করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। আগামীকাল এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে তামিলনাড়ু উপকূলে আঘাত হানতে পারে।

এবারের এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘মন্থা’। থাইল্যান্ডের দেওয়া এই নামের অর্থ ‘সুগন্ধি ফুল’ হলেও এটি যেন বিপদের বার্তা। কেউ কেউ মজা করেই বলছেন, মন্থার অর্থ ফুল হলেও বাস্তবে তা ঠিক ফুলের মতো শান্ত? আবহাওয়া দপ্তর বিশ্বজুড়ে যে ঝড়, ঘূর্ণিঝড় ঘনীভূত হওয়ার পূর্বাভাস পেয়ে থাকে, একেক সময় একেক দেশ তার নামকরণ করে। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) পাঁচটি বিশেষ আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থার (আরএসএমসি) সঙ্গে সমন্বয় করে ২০০৪ সাল থেকে এভাবে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের সমুদ্র উপকূল ও এর আশপাশের এলাকায় ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সোমবার (২৭ অক্টোবর) আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থায়’ পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এটি দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় (১১.৭° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৫.৫° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে) অবস্থান করছে।

ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার রাত ৩টার দিকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৬০ কিলোমিটার, কক্সবাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার, মোংলা থেকে ১ হাজার ২৮০ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ১ হাজার ২৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়ের নাম কেন রাখা হয়

আগে ঘূর্ণিঝড়ের আলাদা কোনো নাম ছিল না। যেমন ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়; যেগুলো এখনো বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে অমলিন, কিন্তু সেগুলোর কোনো আনুষ্ঠানিক নাম ছিল না। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে আঘাত হানা ঝড়গুলোকেও একসময় নামবিহীনভাবেই শনাক্ত করা হতো।

তবে সময়ের সঙ্গে আবহাওয়াবিদদের মধ্যে প্রয়োজন দেখা দেয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর আলাদা পরিচয় দেওয়ার। কারণ, কোনো ঝড়ের নাম না থাকলে তার শক্তি, গতিপথ, সময় ও প্রভাব সংক্রান্ত তথ্য দ্রুত প্রচার করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার অতীতের ঝড়ের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস তৈরি করতেও সময় লেগে যেত অনেক বেশি। এই কারণেই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের প্রথা শুরু হয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) ২০০৪ সাল থেকে পাঁচটি আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থা বা রিজিওনাল স্পেশালাইজড মেটিওরোলজিক্যাল সেন্টারের (আরএসএমসি) সহযোগিতায় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ চালু করে।

এই আরএসএমসিগুলো তাদের সদস্যদেশগুলোর কাছ থেকে সম্ভাব্য নামের তালিকা চায়। প্রতিটি দেশ নির্দিষ্ট সংখ্যক নাম প্রস্তাব করে, পরে যাচাই-বাছাই শেষে সংক্ষিপ্ত তালিকা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় ডব্লিউএমও’র কাছে।

বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে একটি বিশেষ আঞ্চলিক কমিটি, যার নাম ডব্লিউএমও/এসক্যাপ প্যানেল অন ট্রপিক্যাল সাইক্লোনস (PTC)। এই প্যানেলে রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, ইরান, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, ইয়েমেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মোট ১৩টি দেশ।

২০১৮ সালে এই প্যানেল নতুন করে নামের তালিকা তৈরি করে—যেখানে প্রতিটি দেশ ১৩টি করে নাম প্রস্তাব করে। তবে নাম নির্ধারণে কিছু নীতিমালা মানা বাধ্যতামূলক। যেমন—

* কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস বা সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত নাম রাখা যাবে না।
* লিঙ্গ, জাতি বা সম্প্রদায়ভেদে বিভাজন সৃষ্টি করে এমন নাম অনুমোদন পাবে না।
* নামটি সংক্ষিপ্ত, সহজে উচ্চারণযোগ্য ও সর্বোচ্চ আট অক্ষরের হতে হবে।
* বিশ্বের কোনো জনগোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত হানে, এমন নামও গ্রহণযোগ্য নয়।

এছাড়া সদস্যদেশগুলো চাইলে সময়ের সঙ্গে নিজেদের প্রস্তাবিত নাম সংশোধন করতে পারে। নামের তালিকা তৈরি হয় ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে সদস্যদেশগুলোর নাম সাজিয়ে। ফলে তালিকার শুরুতে থাকে বাংলাদেশ, আর শেষ প্রান্তে ইয়েমেন। এইভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় একটি স্বতন্ত্র নাম পায়, যা শুধু শনাক্তকরণ নয়, দুর্যোগ মোকাবিলার সমন্বয়েও সহায়তা করে।