রাবিতে ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতন দিবস পালিত
২০০৭ সালের আগস্টে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনার স্মরণে ‘ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতন দিবস’ পালিত হয়েছে। বুধবার (২৪ আগস্ট) বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে আয়োজিত এক আলোচনা সভার মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারের সভাপতিত্বে এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য মো. আয়েন উদ্দিন এমপি। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক (অব.) মো. অবায়দুর রহমান প্রামানিক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. আবদুস সালামের সঞ্চালনায় স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য দেন ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মামুন, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের মো. সাখাওয়াত হোসেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মো. সাদেকুল ইসলাম প্রমুখ।
আলোচনাকালে অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক বলেন, ২০০৭ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তা তাঁদের মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্বের চেতনা থেকেই করেন। জাতির ক্লান্তিকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে।
অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস সেই নিপীড়ন ও হয়রানির নিন্দা জানিয়ে বলেন, হয়রানিমূলক মামলার মাধ্যমে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার যে চক্রান্ত করা হয় তা ব্যর্থ হয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। দিবসটি যাতে নিয়মিত পালন করা হয় তার জন্যও কর্তৃপক্ষের প্রতি তিনি আহ্বানন জানান। এছাড়াও নির্যাতনের সঠিক তদন্তের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের প্রস্তাব করেন তিনি।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সেদিনের সেই সম্মিলিত প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০০৭ সালের আগস্টে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও নৈতিক দায়িত্ববোধের চেতনা থেকে। সে আন্দোলন-প্রতিবাদের ফলে ক্ষমতাসীন সরকার দমননীতির পথ গ্রহণ করে। কিন্তু এক সময় অনুভব করে যে সে প্রতিবাদকে দমন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মামলা থেকে সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন বলেন, এদেশের ছাত্র সমাজ সবসময় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালের এ মাসে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে হটানোর জন্য নয়, আমরা একত্রিত হয়েছিলাম মূলত আমাদের জেলখানায় বন্দি থাকা জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনের জন্য। এমনকি অগণতান্ত্রিক সরকারের দমন- পীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আবারও তাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে।
এ ছাত্রনেতা আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করার সুতাটুকু খুঁজছিলাম। ঠিক সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার সূত্র ধরে আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। সে সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটা প্রশাসন ছিলো, যে প্রশাসন ছাত্রদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে হেলমেট পরে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করেছিল। এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক।
সভায় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম বলেন, ২০০৭ সাল ছিল জাতির জন্য এক ক্রান্তিকাল। সে সময় গণবিচ্ছিন্ন কিছু মানুষ অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘায়িত করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। কিন্তু সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে সেই অপশক্তি পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভবিষ্যতেও সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদী ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এছাড়া ২০০৭ সালের আগস্টে সেই সময়ের সরকার কর্তৃক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান আলোচকবৃন্দ।
তৎকালিন নির্যাতিত শিক্ষক ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ২০০৭ সালের আগস্ট মাসের ঘটনাটি আমার কাছে তুচ্ছ ঘটনা নয়। এটি ইতিহাসের একটি অনিবার্য ঘটনা। যা অবশ্যম্ভাবী ছিল। সেটি একটি ঘটনার মাধ্যমে স্ফুলিঙ্গ আকারে প্রকাশ পেয়েছিল এবং এটা ঘটতই। যা ছিল ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের এক শুভ বিপ্লব। যার চালিকাশক্তি ছিল মঙ্গলময় এক জীবনধারায় সৃষ্ট শুভ চেতনা। এই শুভ চেতনারই সেদিন বিস্ফোরণ ঘটেছিল।
উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ সবসময়ই নৈতিক ও বিবেকবোধের দৃষ্টিকোণ থেকেই সব অন্যায়- অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে এবং অবশেষে তারাই জয়ী হয়েছে। আগামীতেও সকল ন্যায় সঙ্গত আন্দোলন সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের এই গৌরবময় ধারা অক্ষুণ্ন থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালের ২২ আগস্টে রাবি ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিয়ার গ্যাসের সেলের আঘাতে নিহত রিকসাচালক আনোয়ার আলীর পরিবারকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা অনুদান দেয়ার কথা জানান উপাচার্য।
২০০৭ সালে ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের সঙ্গে সেনা সদস্যদের সংঘর্ষ বাধে। পরদিন দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সেই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলন কালে পুলিশ ও সেনাদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হন অনেক ছাত্র-শিক্ষক।
এমনকি মিথ্যা মামলা দিয়ে ৮ শিক্ষক ও এক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই দিন শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত কয়েকশ জন আহত হন। পরবর্তীতে এ দিনটিকে 'ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতন’ দিবস ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। তারপর থেকে প্রতিবছর ২৪ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতন’ দিবস পালিত হয়ে আসছে।