রাবি ভর্তিচ্ছুদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে নগরবাসী, শিক্ষার্থী-প্রশাসনের প্রশংসা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক ও স্নাতক (সম্মান) প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে টানা তিনদিন চলা এ পরীক্ষায় আবাসন, যাতায়াত ও খাবারের দামবৃদ্ধিসহ নানা কারণে নগরবাসীর ওপর ক্ষুব্ধ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। তবে প্রশংসিত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে নগরীর কিছু জায়গায় রাতারাতি যাতায়াত ও খাবারের মূল্যবৃদ্ধিসহ মালিকদের আবাসন সংক্রান্ত জটিলতা বৃদ্ধি পায়। ভোগান্তিতে পড়েন অনেকে। অন্যদিকে নিজের বিছানা ভাগাভাগি করার পাশাপাশি দিনরাত ভর্তিচ্ছু ও অভিভাবকদের সেবায় নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী।
এ ছাড়া সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুষ্ঠুভাবে ভর্তির সার্বিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে কাজ করে প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক কর্মী ও আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
বরিশালের ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী মারুফা বলেন, শহরে এক বান্ধবীর কাছে উঠেছিলাম। যাতায়াতে অতিরিক্ত রিকশা ভাড়া এবং খাবারের দোকানে দাম বৃদ্ধিসহ নগরীতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে ক্যাম্পাসের পরিবেশ মনোরম এবং প্রশাসনের নানা উদ্যোগ বেশ ভালো ছিল।
যশোরের নাহিয়ান খান নামে এক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী বলেন, রাতে রেলস্টেশনে নেমে অটোতে উঠে ক্যাম্পাসে আসতে ১৫০ টাকা লেগেছে। এটাই নাকি আজকের সর্বনিম্ন ভাড়া।
আরো পড়ুন: চলন্ত বাসে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছুকে যৌন নিপীড়ন, চালক গ্রেফতার
মেয়ে নিয়ে গাজীপুর থেকে আসা সাকিলা বেগম শেষ দুই দিন ছাত্রী জিমনেসিয়ামে অবস্থান করেছেন। তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষাকেন্দ্রীক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সার্বিক প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা খুবই চমৎকার ছিল। পরীক্ষার আগেরদিন পর্যন্ত যখন রাজশাহী কোন হোটেল কিংবা অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থান নিশ্চিত হচ্ছিল না, তখন খুবই চিন্তার মধ্যে পড়ে ছিলাম। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই মেয়ের স্বপ্ন পূরণে আল্লাহর নাম নিয়ে ক্যাম্পাসে আসি।
তিনি বলেন, মজার বিষয় হচ্ছে রাতে নেমে যখন এক জায়গায় দাড়িয়ে জড়সড় হয়ে ভাবছি কোথায় যাব, তখন এখানকার এক ছাত্র এসে থাকার ব্যবস্থা নেই জেনে জিমে উঠিয়ে দিল। টাকা দিলে রাতের খাবার এনে দিল। এখানে দায়িত্বে থাকা সবােই অনেক সহযোগিতাপ্রবণ ছিলেন জানিয়ে প্রশাসনের এমন উদ্যোগের প্রশংসা করেন তিনি।
মানিকগঞ্জের আবছার আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা এতটা সহযোগিতা করতে পারে, এখানে না আসলে জানতাম না। ঘরে অন্যকে থাকতে দিয়ে ক্যাম্পাসে গভীর রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার ঘুরে ঘুরে কেউ কাগজ কুড়াচ্ছে, কেউ অপরিচিতদের থাকার জায়গা দেখে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ভালো একটা অভিজ্ঞতা পেলাম।
এ ছাড়া ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা হাজারও শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ক্যাম্পাসে পৌছে নিরাপদে অবস্থান করার সুযোগ পেয়েছে। গভীর রাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া, থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা। এমনকি নিরাপদে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তাদের পাশে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ সমাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতা ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আলাদা ব্যবস্থা থাকায়, এমন উদ্যোগের বেশ প্রশংসা করেছেন তারা। তবে পরীক্ষা চলাকালে প্রক্সি দেয়ার বিষয়টি বিতর্ক সৃষ্টি করলেও প্রশাসনের শক্ত ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রক্সির সাথে সংশ্লিষ্ট পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়ে সেদিনই জেলহাজতে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত। তা ছাড়া শুরু থেকেই ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির সুযোগ নেই বলে জানিয়ে আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আরো পড়ুন: ভর্তিচ্ছুদের কোনটি দরকার, ভালো বিষয় না পাবলিকে একটি সিট?
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম বলেন, প্রতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা বিশাল চ্যালেঞ্জ। কেননা এখানে সবার নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম জড়িত। তবে আমরা ক্যাম্পাসে সর্বস্তরের নিরাপত্তার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুষ্ঠু ও নির্ভেজালভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করেছি। কেননা পরীক্ষায় সব ধরনের জালিয়াতি রোধে সোচ্চার ছিল বিশেষজ্ঞ টিম ও শিক্ষকেরা। ফলে জালিয়াতি করে পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক শাস্তি নিশ্চিত করেছি।
তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের ভিতরে দিনরাত সব রকমের নিরাপত্তা জোরদার ছিল। তবে ক্যাম্পাসের বাইরে টুকটাক অনাকাঙ্ক্ষিত যে ঘটনা ছিল, সেগুলো জানা মাত্র ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশাল কর্মযজ্ঞ পাড়ি দিতে গিয়ে সবকিছু হয়তো পারিনি, সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। তা ছাড়া ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরলস পরিশ্রম ও ত্যাগ ছিল প্রশংসার দাবিদার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার সবলেন, নিঃস্বার্থভাবে এ কয়েকদিন খেয়ে-না খেয়ে, ঘুমিয়ে-না ঘুমিয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পাশে থাকার যে নজির স্থাপন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন, মিডিয়াকর্মী সবার সার্বিক সহযোগিতায় বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উপাচার্য বলেন, এভাবে সর্বদা নিঃস্বার্থভাবে একে-অন্যের পাশে থাকলে কখনো পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
২০২১-২২ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ২৫-২৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার সব ইউনিটে মোট ভর্তিচ্ছুর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৭৮ হাজার। তবে পরীক্ষা চলাকালে রাজশাহী নগরীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভর্তিচ্ছু ও অভিভাবক মিলে প্রায় তিন লাখ মানুষের সমাগম হয়।
নগরীতে চাহিদা অনুসারে আবাসন সংকট থাকলেও ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সার্বিক প্রস্তুতি বিষয়ক ১৫ স্তরের নিরাপত্তাসহ ক্যাম্পাসের হল, জিমনেসিয়াম, মসজিদ ও মন্দিরে স্বাধ্যমতো আবাসনের ব্যবস্থা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমন ব্যবস্থাপনায় প্রথম দিন থেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেন ভর্তিচ্ছু ও অভিভাবকেরা।