ফেসবুক পোস্টের বলি জাবির বাবু, পরিবারের হাল ধরার স্বপ্নভঙ্গ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ২০১১-১২ সেশনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্র মো. শামসুল আলম বাবু। পাবনা সদর উপজেলার আতাইকুলা থানার নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আট ভাই-বোনের মধ্যে ৫ম তিনি। ছোটবেলা থেকে ছিলেন মেধাবী, চঞ্চল ও পরিশ্রমী। এলাকার স্কুল-কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
বাবা সেকান্দর প্রামাণিকের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অভাবের সংসারে স্বপ্ন দেখতেন, ছেলে বাবু পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করবে। সংসারে হাল ধরবে। সেই স্বপ্ন পূরণে পড়াশোনা শেষ করে নিচ্ছেন চাকরির প্রস্তুতিও। সম্প্রতি সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডারে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার ও অসাবধানতার কারণে এই শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের স্বপ্ন এখন দু:স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
২০১৫ সালের একটি মামলায় গতকাল সোমবার (৬ জুন) সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীকে। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এই দণ্ড দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করার অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় এই কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ৫ অগাস্ট তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়। এরপর ৫ মাস জেলে ছিলেন শামসুল। এরপর জামিনে বের হলেও মামলার তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হয়। ওই বছরেরই ২১ জুলাই ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বিচারের সময় ৯ জনের সাক্ষ্য শুনে সোমবার রায় দেন বিচারক।
আরও পড়ুন;মাঙ্কিপক্স সন্দেহে দেশে একজন হাসপাতালে ভর্তি
এদিকে, ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুুতি নিতে থাকেন শামসুল। এরইমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি একাধিক চাকরির ভাইভার মুখোমুখি হয়েছেন। সবশেষ গত ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলে বিসিএসের নন-ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।
এদিকে সোমবার রায় ঘোষণার পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৬ মাস আগে তার বাবা মারা গেছেন। এই শোকে তার মা সুফিয়া খাতুন এখন এখন ভেঙ্গে পড়েছে। আজ মঙ্গবার দুপুরের আগ পর্যন্ত তাকে ছেলের এই সাজার খবর জানানো হয়নি। দুপুরের দিকে শাসুলের চাচাতো ভাই মিন্টুর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
এসময় তিনি বলেন, গ্রামের সবাই বাবুকে (শামসুল) অনেক পছন্দ করতো। সবসময় পড়াশোনা নিয়ে বেশি ব্যাস্ত থাকতো সে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো বাবু। বাবুর এ রায়ে পরিবারে পাশাপাশি তারাও অনেক হতবাক হয়েছে। এসময় মুঠোফোনের ওই প্রান্তে শামসুলের মায়ের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
বাবুর বাল্যকালের বন্ধু হাসান রাব্বি বলেন, বাবু ছিলো একজন সহজ-সরল ছেলে৷ তাদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলো। ছোট বেলা থেকেই ক্লাসের টপার ছিলো কোনদিন কারও সাথে ঝামেলা করেনি। সব বন্ধুদের সঙ্গে ছিলো ভালো সম্পর্ক৷ সামান্য ভুল ও অসাবধানতার কারণে আজ সব শেষের পথে।
আরও পড়ুন;সার্কাসের নামে চলছিল অশ্লীলতা, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বন্ধ
মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট সরকার ও রাজনৈতিক বিভাগের ৩৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আল আমিন সেতু বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের ওপর একটি কলাম পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ওই লেখাটি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোরশেদুর আকন্দ ফেসবুকে পোস্ট করেন।
ওই পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় শামসুল আলম বাবু তার ‘মো: কবির মামু’ নামের ফেসবুক আইডি থেকে একটি মন্তব্য করেন। যেখানে তিনি বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেন।
আল আমিন সেতু লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালে বাবুকে আটক করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ইয়াকুব আলী মিয়া তাকে আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর করে লিখিত অভিযোগ করেন।
এদিকে, বাবুর কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবু ছিলো একজন সহজ-সরল ছেলে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এসেও তার স্বভাব-চরিত্র ছিল নম্র ও ভদ্র। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। ইসলামিক জীবন-যাপন করতেন।
কটূক্তি করার পর সেটা ভাইরাল হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতারা তাকে খুঁজে বের করে । পরে ভিসির অনুরোধ এক ছাত্র মামলা করে। সেই মামলায় সোমবার তার সাজা হয়েছে।
জাবি শিক্ষার্থীর ৭ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণার পর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাপক সমালোচনার মুখে বাংলাদেশে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কিছু ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করা হয়। সেই আইনে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে, তবে এই ধারার অপরাধগুলোকে বিস্তারিতভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।
এর আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও সাংবাদিকদের কারাগারে নেওয়ার একাধিক ঘটনা তীব্র সমালোচনা তৈরি করেছিলো। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের তরফ থেকে এটি নিবর্তনমূলক আখ্যা দিয়ে আইসিটি আইন বাতিলের দাবি করা হয়েছিলো।
শুরু থেকেই সম্পাদক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা তথ্য প্রযুক্তি আইনকে আইনকে কালো আইন আখ্যায়িত করে এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে এসেছেন।
এই আইনে সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, খুলনার সাংবাদিক আব্দুল লতিফ মোড়ল, লেখক ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুলসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা কার হয়েছিল।
তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ২০১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এখন পর্যন্ত ২০ জনের মত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই বছর প্রথম ছয় মাসে মামলা হয়েছিল ৩৯১টি।
শুরু থেকেই সম্পাদক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা এ আইনকে কালো আইন আখ্যায়িত করে এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে এসেছেন।
গণমাধ্যম কর্মীদের হয়রানিতে আইনটি ব্যবহার হচ্ছে জানিয়ে একাধিকবার ওই আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদ। সংবাদপত্র মালিকদের সমিতি নোয়াব এবং টিভি মালিকদের সমিতি অ্যাডকো এক যৌথ বৈঠকে একমত হয়েছিল যে, ৫৭ ধারার অপ্রপ্রয়োগ হচ্ছে এবং সাংবাদিকদের মত প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একাধিক বিবৃতিতে বলেছে, আইসিটি আইনের কিছু ধারা মত প্রকাশের প্রতি হুমকিস্বরূপ।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট গঠনের সময় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, নতুন আইনে ৫৭ ধারা থাকবে না।
যেদিন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুমোদন করে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা, সেদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, আমি কথা দিয়েছিলাম যে ৫৭ ধারা থাকবে না। আজ মন্ত্রিসভা ৫৭ ধারা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিলো সে বিতর্কের অবসান ঘটলো।
কিন্তু নতুন আইনেও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে।