অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য

জাবিতে লেক পুনঃখননের নামে ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ

৬৫ লাখ টাকার মধ্যে একটি টাকাও খরচ করা হয়নি
৬৫ লাখ টাকার মধ্যে একটি টাকাও খরচ করা হয়নি  © টিডিসি ফটো

লেক পুনঃখননের নামে ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘Strengthening Fisheries Research and Aqua-garden for Biodiversity Conservation in Jahangirnagar University’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় মোট ২১টি খাতে বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রকল্প পরিচালক (অধ্যাপক সালাম) ৩টি লেক পুনঃখনন বাবদ ৬৫ লাখ টাকার একটি টাকাও খরচ করেননি। 

এদিকে বরাদ্দের পুরো টাকাটা তছরুপ করা হলেও শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রকল্প সমাপনী প্রতিবেদনও দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ। তবে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে গবেষণা প্রকল্পের আড়ালে অর্থ আত্মসাতের এই ঘটনা। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের কথাতেও উঠে এসেছে কতটা ধূর্ততার সাথে এ কাজ করেছেন তিনি।

প্রকল্পটির সহযোগী ইনভেস্টিগেটর (উপ-প্রকল্প পরিচালক) ছিলেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আরেক অধ্যাপক মানসুরুল হক। তিনি এই প্রকল্প থেকে বেতন ও ভাতা বাবদ প্রায় ১১ লাখ টাকা নিয়েছেন। অধ্যাপক মানসুরুল হকের সঙ্গে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানিনা।  ওনাকে (অধ্যাপক সালামকে) জিজ্ঞাসা করুন। তখন রাত প্রায় নয়টা বাজলেও ক্লাসে আছেন বলে মুঠোফোনের কল কেটে দেন তিনি। এরপর তাঁর মেইল ঠিকানায় একাধিকবার মেইল করে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি 

প্রকল্পটিতে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইনামুল হক ও সহযোগী অধ্যাপক সাবিরা সুলতানা। দুজনই তখন প্রভাষক ছিলেন।

সহযোগী অধ্যাপক ইনামুল হক বলেন, আমি প্রজেক্টের একদম শুরুর দিকে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছি। সাথে ছিলেন আমার সহকর্মী সাবিরা সুলতানা। সেখান থেকে মাত্র ২ হাজার টাকা করে সম্মানী দেওয়া হতো। প্রজেক্টে ২০১২-২০১৪ সাল পর্যন্ত কাজ করার পর আমি শিক্ষা ছুটিতে বিদেশ যাই। হ্যাচারী সংক্রান্ত বিষয়ে একটু কাজ করেছি কিন্তু লেক পুনঃখনন নিয়ে আমি কিছু জানিনা।

সহযোগী অধ্যাপক সাবিরা সুলতানা বলেন, শুরুর দিকে আমি প্রজেক্টে ছিলাম। তখন আমি বিভাগে কেবল জয়েন করেছি। স্যার মাসে ১-২ হাজার করে টাকা দিতো। মাঝেমাঝে কিছু চেকে স্বাক্ষর নিতো কিন্তু আমাদের সম্পর্ক সহকর্মীর চেয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী টাইপের হওয়ায় কিছু বলতে পারিনি। কাজগুলো সম্পর্কে স্যার আমাদের তেমন কিছু বলতো না। তাছাড়া ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা।

তবে আলাপের এক পর্যায়ে বিরক্তির সাথে বলেন, স্যার কিন্তু গভর্নমেন্টের সাথে ডিলিং করে এটা আনছে। এটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা না। আর সরকার থেকে উনি সার্টিফিকেট (পিসিআর) ও পাইছে। আমি নিজেও স্পেসিফিকেশন যাচাই সংক্রান্ত (হ্যাচারী কমপ্লেক্সের মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য) কমিটিতে আছি।

সুবিধাভোগী হয়ে যাচাই সংক্রান্ত কমিটিতে থাকতে পারেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলে, আমি তো ইচ্ছে করে কমিটিতে আসি নাই। ভিসি ম্যাডাম (সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম) আমাকে ভালোবেসে কমিটিতে দিয়েছেন।

তখন এ নিয়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে মুঠোফোনে ও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে পাওয়া যায় নি। করোনার কারণে সরাসরি দেখা করাও সম্ভব হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলো দেখাশোনা করে এস্টেট অফিস। এস্টেট অফিস সূত্রে জানা যায় সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের সময় কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা প্রকল্প) থেকে ৭টি লেক পুনঃখনন করা হয়। এছাড়া আর কোনো লেক পুনঃখনন করা হয়নি। এজন্য দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস কথা বলে এস্টেট অফিসের তৎকালীন অফিস প্রধানের। তিনিও কাজ না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।

এরপর ৩ নভেম্বর ২০১২ থেকে ১ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত এস্টেট অফিস প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ববিদ নুরুল আমিন। নুরুল আমিন বর্তমানে অবসরে আছেন। তিনিও একই তথ্য জানান। নুরুল আমিন বলেন, কাবিখা প্রকল্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ টি লেক পুনঃখনন ছাড়া আর কোনো লেক পুনঃখনন করা হয় নি। তবে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সালাম স্যারের একটি প্রকল্প থেকে লেক পুনঃখননের কথা ছিলো। পরে তিনি বিদেশে চলে যাওয়ায় সেটি হয়নি।

খাতভিত্তিক তথ্য দিয়ে কোন কোন লেক পুনঃখনন করা হয়েছে জানতে চাইলে অধ্যাপক আব্দুস সালাম  বলেন, এই খাতের অর্থ রিএ্যাডজাস্টমেন্ট (আন্তঃখাত সমন্বয়) সমন্বয় করা হয়েছে। লেক পুনঃখনন খাতে বরাদ্দ ৯৬ লাখ থেকে কমিয়ে ৬৫ লাখ করা হয়েছে - বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন খাতের সাথে রিএ্যাডজাস্টমেন্ট করা হয়েছে? এর কোনো জবাব তিনি দিতে পারেননি।

এরপর এক পর্যায়ে অর্থ তছরুপের বিষয়টি স্বীকার করে এই অধ্যাপক বলেন, আসলে মন্ত্রণালয় থেকে একটা প্রজেক্ট আনা এতো সহজ না। তিন বছর পরিশ্রম করে তারপর এটা আনতে হয়েছে। হিসেবের কম-বেশিতে হয়তো কিছু টাকা এদিক-ওদিক হয়েছে। আমার রিটায়ারমেন্টের টাকা তো ইউনিভার্সিটিতে আছে। সেখান থেকে দেওয়া যাবে।

কাজ না করেই শতভাগ কাজের সনদ
তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে কোনো কাজ না করেও শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রকল্প সমাপনী প্রতিবেদন দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে গত ৩ নভেম্বর ২০১৬ সালে ওই বিভাগ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন করে ও বিভিন্ন ডকুমেন্টস দেখে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

‘বড় বিশ্ববিদ্যালয়’ হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে সাফাই গেয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা ও ওই বিভাগের সেক্টর-৭ এর বর্তমান উপ-পরিচালক (উপসচিব) এবং তৎকালীন সেক্টর-৬ এর উপপরিচালক মশিউর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আসলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড় হওয়ায় পুরোটা ঘুরে দেখা সম্ভব হয়নি। পরে ব্যস্ত আছে বলে ফোন কেটে দেন তিনি। এরপর কয়েকবার মেইল করা হলে এবং মুঠোফোনে কল দিলেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি তার।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবীক্ষণ বিভাগের সেক্টর ৬-এর মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. শুকুর আলী বলেন, আমি গত ফেব্রুয়ারি মাসে যোগদান করেছি। পুরানো প্রকল্প হওয়ায় আমি তেমন কিছু জানিনা। বিষযটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখবো। পরে এরকম যাতে না হয় সেটিও নিশ্চিত করার চেষ্টা থাকবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম বলেন, একটি অডিট (স্পেসিফিকেশন যাচাই-বাছাই কমিটির) কাজ চলছে বলে জানি। কমিটির রিপোর্ট পেলে এরপর মন্তব্য করবো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একজন সদস্য দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। আমাদের পূর্ণাঙ্গ মিটিং না হওয়ায় মন্তব্য করা যাচ্ছে না।

বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ ধরনের বিষয় তো কাম্য নয়। এটা প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের কাজ। তাদেরকে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেবো।

অর্থায়নকারী সংস্থা হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অতিরিক্ত সচিব আবু ইউসুফ আহমেদের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানের গল্প
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র সংলগ্ন একটি জঙ্গলাকীর্ণ ভবনেন নাম ‘মৎস্য গবেষণায় ও হ্যাচারী’। তবে হ্যাচারী কেন পড়ে থাকবে? এটিকে প্রাথমিক ভিত্তি ধরেই এগিয়ে চলে অনুসন্ধান। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে জানা যায় ভবনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘Strengthening Fisheries Research and Aqua-garden for Biodiversity Conservation in Jahangirnagar University’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নির্মিত।

পরে জানা যায়, প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। অনুসন্ধানের শুরুর দিকে কিছু প্রাথমিক অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে প্রকল্প পরিচালকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি একদিকে স্বেচ্ছাবসরের আবেদন করছেন, অন্যদিকে বিদেশে অবস্থান করায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আব্দুস সালাম ফেসবুক মেসেঞ্জার অ্যাপেই সবার সাথে যোগাযোগ করেন। তাই চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ও ৪ ফেব্রুয়ারি মেসেঞ্জারেই সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় এই প্রতিবেদকের।

তকে মেসেঞ্জারে অনেকদিন সাড়া পাওয়া যায়নি তার। উপায় না পেয়ে বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার একটি সূত্র প্রকল্প সমাপনী প্রতিবেদন (পিসিআর) সহ বেশকিছু নথি সরবরাহ করে।

প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, প্রকল্পটি ২০১২ সালের অক্টোবরে শুরু হয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। প্রকল্পের মোট ২১টি খাতে সাড়ে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এর অন্যতম উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলোতে এ্যাকোয়া গার্ডেন তৈরি করা। এজন্য ৩টি লেক পুনঃখনন বাবদ ৯৬ লাখ টাকা প্রাথমিক বরাদ্দ রাখা হয় যা পরবর্তীতে ৬৫ লাখ টাকা করা হয়। লেক খননের কথা জিজ্ঞাসা করলে সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া ছিল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত।

চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আব্দুস সালামের ই-মেইল ঠিকানায় বিস্তারিত জানতে চেয়ে মেইল করা হলে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব দেননি। তিনি মেইলে লিখেন, প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আপনি যে তথ্যগুলো দিয়েছেন সেগুলো ভুল।

পরে তার কথামত ‘সঠিক’ তথ্য জানতে চেয়ে আরও দুইবার প্রশ্ন পাঠালেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এদিকে গত ১৯ এপ্রিল একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর পাওয়া যায়। ওইদিন অধ্যাপক আব্দুস সালামের সঙ্গে ঘন্টাখানেকের কপোথকথনেও উঠে আসে ঘটনার সত্যতা। যদিও সেদিন এ নিয়ে মোটেও কথা বলতে চাননি তিনি। অনেক অনুরোধে কথা বললে উঠে আসে বিস্তারিত বর্ণনা। 

অনুসন্ধানের বাকি অংশ আসছে পরের কিস্তিতে...


সর্বশেষ সংবাদ