কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা শাটলের ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সংকট সমাধানে শিক্ষার্থীদের ভাবনা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সংকট সমাধানে শিক্ষার্থীদের ভাবনা  © টিডিসি ফটো

পাহাড়ি নৈসর্গিক সবুজায়নে আবৃত আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ স্বায়ত্তশাসিত বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অব্যস্থাপনা, রাজনৈতিক সহিংসতা, স্থানীয়দের আধিপত্য, বেহাল শাটল ট্রেন ব্যবস্থা, আবাসন সংকট, রুটিন মাফিক মানসম্মত ক্লাস না হওয়া ইত্যাদির কারণে চবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হতাশায় ও ক্ষোভে দিনাতিপাত করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। বরং প্রতিনিয়ত সমস্যাগুলোর সংকট বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান বিভিন্ন সমস্যার চিত্র বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. মুরাদ হোসেন।

  • ঐতিহ্যের শাটল এখন মরণ ফাঁদ

সবুজ পাহাড়ে ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অন্যতম আকর্ষণ শাটল ট্রেন। যা শুধু শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যমই নয়, বরং এর সাথে মিশে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলার সুদীর্ঘ সোনালী ঐতিহ্য। কিন্তু বর্তমানে অপ্রীতিকর কিছু ঘটনা এই ঐতিহ্যকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ আজ সাধারণ শিক্ষার্থীর রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে আমাদের প্রাণের শাটল ট্রেন। দীর্ঘদিন যাবত ২২ কি.মি. এই রেলপথের বিভিন্ন স্থানে ঘটতে দেখা যায় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা। বর্তমান সময়ে যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

গত একমাসে প্রায় ১৭ জন শিক্ষার্থী পাথরের আঘাতে আহত হওয়ার ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বারংবার অবহিত করার পরও যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এই অপরাধ কর্মকাণ্ডের পরিমাণ পূর্বের থেকেও বেড়ে গেছে।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের এই শাটল ট্রেন বহিরাগতদের জন্য হয়ে উঠেছে ফ্রিতে এক উপভোগ্য ভ্রমণ আর অবাধ বিচরণ মাধ্যম। যা চুরি, ছিনতাই এমনকি জন্ম দিয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার। অর্থাৎ প্রাণের শাটল এখন হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের মরণ ফাঁদ। আর তাই এই সমস্যার সমাধানে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক দোষীদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনবে–এটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের দাবি।

মোহাম্মদ খাইরুল শেখ
বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

  • ক্যাম্পাসে চক্রাকার বাস সার্ভিস চাই

২১০০ একর আয়তনের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৭৫৫০ জন। ক্যাম্পাসে বৃহৎ সংখ্যক শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য যানবাহনের রয়েছে ব্যাপক সংকট। যেসব সিএনজি ও অটোরিক্সা ক্যাম্পাসে চলাচল করে তা শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট ব্যয়বহুল। দৈনিক যাতায়াতের জন্য একজন শিক্ষার্থীর প্রায় ৫০-৬০ টাকা খরচ হয়ে যায় শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ভাড়ায়। যার দ্বারা একজন শিক্ষার্থী আবাসিক হল থেকে দু’বেলা খাবার সংগ্রহ করতে পারে।

আরও পড়ুন: ট্রেনের নাম ‘শাটল’ কেন?

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সাথে সিএনজি ও রিকশা চালকদের দুর্ব্যবহার নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও সেটি মানছে না চালকরা। তাদের অতিরিক্ত ভাড়া দাবির কারণে প্রায়শই শিক্ষার্থী ও চালকদের মধ্যে হচ্ছে বাকবিতণ্ডা। এমনকি প্রতিনিয়তই এসব চালকের হাতে শারিরীক ও মানসিক হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে চবি শিক্ষার্থীদের। নারী শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

শিক্ষার্থীদের মতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু করলে শিক্ষার্থী হয়রানি বন্ধ হবে। একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু থাকলেও ২০১৫ সালে প্রশাসন সেটিকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন বাজেট স্বল্পতার কারণে। বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পুনরায় চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু করা হলে শিক্ষার্থীদের দৈনিক ব্যয় অনেকাংশেই কমে আসবে। সেই সাথে কমে আসবে নিত্তনৈমিত্তিক হয়রানি।

ফুয়াদ হাসান
শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

  • স্থানীয় অসাধু চক্রের দৌরাত্ম বন্ধ করুন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি আবেগ ও ভালোবাসার স্থান। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের স্বপ্নপুরী। প্রতিবছর হাজারো শিক্ষার্থী নিজেদের মেধা ও যোগ্যতায় ডানা মেলে এখানে। তবে, এই স্বপ্ন পূরণের পথে স্থানীয় এলাকাবাসীর সাহায্য সহযোগিতা নেই বললেই চলে। বরঞ্চ তারা সৃষ্টি করছে নানাবিধ বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও নৈতিকতা বহির্ভূত কার্যক্রম। ক্যাম্পাস ও এর আশেপাশে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া গ্রহণ, ক্যাম্পাসে অবাধ বিচরণ, বিশ্ববিদ্যালয় শাটলে আধিপত্য বিস্তার ও লড়াকু মানসিকতার প্রতিফলন, চলন্ত শাটলে পাথর নিক্ষেপ, ছাত্রীদের হয়রানির অভিযোগও এখন নিত্যদিনের বিষয়। এমন কি দেখে মনে হয় যেন শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের এই বাহন তাদের পৈত্রিক সম্পদ।

আরও পড়ুন: ছিনতাইকারী ধরতে শাটল ট্রেন থেকে লাফ চবি ছাত্রীর

এ ছাড়াও সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থীকে অতর্কিত হামলা ও আঘাত করে আহত করেছে স্থানীয় এই হিংস্র লোকজন। শিক্ষার্থীদের ওপর এমন ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত আচরণ দেশের অন্যত্রও কেবল নৈমিত্তিক বিষয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ, দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। ভেঙে দেওয়া হোক স্থানীয় জনগণের এমন বৈরী মনোভাব ও বর্বরোচিত আচরণ। প্রসারিত করা হোক সুরুচিপূর্ণ সহযোগিতার বন্ধন।

মো. মিজানুর রহমান
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

  • নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অন্যতম সংকটময় সমস্যা হলো ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা সমস্যা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে ৩য় বর্ষের এক শিক্ষার্থীর উপর যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা প্রথম নয়, বরং নানান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সিএনজি-রিকশা চালক ও স্থানীয় বখাটে দ্বারা নানানভাবে হয়রানি এখন নৈত্যনিমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি ক্যাম্পাস নারী শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে উঠেছে অনিরাপদ।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিজস্ব শাটল ট্রেনে আজ নারী শিক্ষার্থীরা নিরাপদ যাতায়াতে শঙ্কিত। বহিরাগত বখাটেদের দ্বারা সম্প্রতি যে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে তা ভবিষ্যতে যাতে আর না ঘটে সেজন্য শাটল ট্রেন ও ক্যাম্পাসে জোরদার করতে হবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাতের শাটলে লাইটিং সিস্টেম না থাকায় সেখানে বখাটেরা চুরি-ছিনতাই ও যৌন হয়রানির মতো অপরাধের সুযোগ পেয়ে বসে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ব্যতিত অন্য কেউ যাতে শাটল ভ্রমণ ও মেয়েদের হলের আশেপাশে ঘুরাফেরা করতে না পারে সেইদিকে প্রশাসনের বিশেষ নজর রাখতে হবে। তাহলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠবে।

জেসমিন আক্তার
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

  • ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করুন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রকৃতির অন্যতম দান। প্রকৃতির আর্শিবাদে ক্যাম্পাসের অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে বাধ্য যে কেউই। উঁচু-নিচু পাহাড়, হরেকরকম বৃক্ষরাজি, পাখির কিচিরমিচির ডাক চবির সৌন্দর্যকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। গাছপালা, পাহাড় এবং নানা ধরনের পশুপাখি ক্যাম্পাসের শোভা বৃদ্ধির পাশাপাশি রক্ষা করছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। গাছপালা আমাদের অক্সিজেন দান ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের সাথে সাথে জীববৈচিত্র্যেরও আধার।

কিন্তু অনেকদিন ধরে চবি ক্যাম্পাসে নানা অজুহাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছপালা কাটা হচ্ছে, পাহাড় কাটাও যেন এখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু অসৎ স্বার্থান্বেষী চক্র আইটি অনুষদ, কলা অনুষদসহ বিভিন্ন পাহাড়ে আগুন লাগাচ্ছে। প্রায় প্রতি বছরই সবুজ পাহাড় আগুনে পুড়ে বিবর্ণ হচ্ছে। বছর বছর বাড়ছে পাহাড়ে অগ্নিকান্ডের হার।

ফলে আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে ছোট-বড় গাছপালা, পাহাড়ী কীটপতঙ্গ। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধ্বংস হচ্ছে, বিনষ্ট হয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র রক্ষার স্বার্থে চবি প্রশাসনের উচিত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও গাছ-পাহাড় খেকোদের বিরোদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি প্রদান করা।

হাসান সেনজিক
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ