অধ্যাপক কন্যার আইনজীবী হওয়ার গল্প সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়
এ যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে। ১৬ বছর আগে খুন হন বাবা। সে সময় সবে আইন পড়া শুরু করেছেন মেয়ে। প্রথমে আইন পড়ায় তেমন আগ্রহী না হলেও পিতৃহত্যার বিচার পেতে আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে আইনজীবী হয়েই সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছেন মেয়ে।
বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তাহের হত্যা এবং বাবার খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সংগ্রাম করে যাওয়া তার মেয়ে এডভোকেট সাগুফতা তাবাসসুম আহমেদের গল্প।
অধ্যাপক তাহেরের একমাত্র কন্যা সাগুফতা। ২০০৬ সালে অধ্যাপক তাহেরকে খুন করে ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়৷ তার মেয়ে তখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। তার শিক্ষক বাবাই তাকে আইন বিষয়ে ভর্তি করেছেন। পিতা হত্যার বিচার নিশ্চিত করার জন্যই আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে আইনি পেশায় আসেন। বাবা হয়ত সেদিন চিন্তাও করেননি, তার কন্যারই আইনি লড়াই করতে হবে পিতার হত্যার দাবিতে।
জানা যায়, অধ্যাপক তাহের হত্যাকাণ্ডের সময় তার মেয়ে সাগুফতা সবে আইন পড়া শুরু করেছেন। বাবা খুন হওয়ার পর বড়ই একা হয়ে পড়েন মা-মেয়ে ও ছেলে। বাবার শোকে প্রতিনিয়ত ব্যাকুল সময় পার করেছেন তারা৷ তবে এক পর্যায়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করে পিতৃহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে আইন বিষয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন সাগুফতা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়া শেষ করেন। পরবর্তীতে আইনজীবী হয়ে লড়া শুরু করেন বাবার খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে। অবশেষে হাজারো বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তার সেই কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ হতে চলেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর আইনী লড়াই শেষে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে যাচ্ছে অপরাধীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দীর্ঘ সংগ্রামের কথা জানিয়ে এই অধ্যাপক কন্যা এডভোকেট সাগুফতা বলেন, এমন নৃশংসভাবে বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, যা আমারা কেউ মেনে নিতে পারিনি। যদিও আমি আইনে পড়াশোনা করেছি, তবে প্রথমে আইনজীবী হওয়ার তেমন ইচ্ছে ছিল না। তবে বাবাকে হত্যা করার পরে এই খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতেই আমি আইনজীবী পেশাতেই আমার সব ধ্যান-জ্ঞান রজু করে সংগ্রাম করতে থাকি। ফলে বাবার বিচার প্রক্রিয়া দিয়েই আমার আইনজীবী হওয়া। কারণ এসব আইনী প্রক্রিয়া অনেক জটিল হয়ে থাকে। তাছাড়া আিন চলে আইনের গতিতে। কিন্তু পিতৃহত্যার সঠিক বিচার আমাদের অধিকার। যা না হলে আমাদের কিছুই পাওয়ার ছিল না। ফলে মাকে নিয়ে আইনী লড়াই করে এই সংগ্রাম চালিয়ে এসেছি। তবে এই সংগ্রাম আমার একার ছিল না, বরং সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা ছিল।
দীর্ঘদিন পরে হলেও সঠিক রায়ে সন্ত্বোষ প্রকাশ করে সাগুফতা বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও বিজ্ঞ আদালত যে সঠিক বিচারের মাধ্যমে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দিয়েছেন, তাতে আমরা অনেকটা সন্ত্বোষ্ট। তবে তখন কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা তখনই পূরণ হবে, যখন এই নৃশংস হত্যাকারীদের রায় কার্যকর হবে।
গত ৫ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ৬ বিচারপতির বেঞ্চের দেয়া এক রায়ে ২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা দুই আসামি একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও নিহত অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম। অপর দু'জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি মো. জাহাঙ্গীর আলমের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সমন্ধি আব্দুস সালাম।
এদিকে আপিল বিভাগের এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক তাহেরের সহকর্মীরা। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তারা বলছেন, এই রায়ের মাধ্যমে আবারো সত্যের জয় হলো।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপক তাহেরের সহকর্মী অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। অধ্যাপক তাহের ছিলেন একজন আদর্শবান ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তাঁকে হত্যা করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় যে আতঙ্ক ও খুনের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, এ রায়ের মাধ্যমে সেই রকম আর কোন পরিবেশ সৃষ্টি হবে না বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা হয়তো তাহের স্যারকে আর ফিরে পাবোনা, কিন্তু এই ন্যায় বিচারের মাধ্যমে তাঁর আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে বলে জানান উপাচার্য।
অধ্যাপক তাহেরের সহকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান উল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ' তাহের স্যার সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। আজকের এই রায়ের মাধ্যমে আমাদের সমাজে একটা মেসেজ গেল, কেউ অন্যায় করে, খুন করে, পার পাবে না। সত্যের একদিন না একদিন জয় হবেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা চাই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আর কোন সময় যেন না ঘটে। আর কোন প্রাণ যেনো এ বিশ্ববিদ্যালয়ে না যায়। এটা একটা পবিত্র অঙ্গন। আমরা এখানে চাই সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক। মানুষ সকল ধরণের হিংসা ও খুনের মতো অন্যায়, জঘন্য কাজ থেকে দূরে থাকুক।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় নৃশংসভাবে হত্যার শিকার অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ। ৩ ফেব্রুয়ারি নিহত অধ্যাপক তাহেরের ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতপরিচয়ে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ এ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল পুলিশ।
২০০৮ সালের ২২ মে এই হত্যা মামলার বিচার শেষে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত ৪ জনকে ফাঁসির আদেশ ও ২ জনকে বেকসুর খালাস দেন। খালাস প্রাপ্ত চার্জশিটভুক্ত ২ জন আসামির মধ্যে ছিলেন তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী।
২০০৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা আপিল করেন। ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল শুনানি শেষে রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুই আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য দুই আসামির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন হাইকোর্ট।
চূড়ান্ত রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ বলেন, ১৬ বছর এর জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি। অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছি। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রায় কার্যকর হলে পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট হবো। খুনীর যে কার্যক্রম, ও যা করেছে আমাদের সাথে চিন্তার বাইরে। ও সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মস্তিস্কে আমার বাড়িতে, আমার অনুপস্থিতিতে, আমার ড্রয়িং রুমে গিয়ে, আমার সোফায় বসে আমার স্বামী হত্যার পরিকল্পনা করেছে। আমার বাড়ির জিনিসপত্র তারা ব্যবহার করেছে। বিনা অনুমতিতে কারো বাড়িতে প্রবেশ করা নিষেধ। সে শিক্ষা সে পায়িনি। এ শিক্ষা পেতে হয় পরিবার থেকে। সবচেয়ে বড় কথা সাজা কার্যকর হোক।