সংস্কারের অভাবে জৌলুস হারাচ্ছে ঢাবি কেন্দ্রীয় মসজিদ
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত একশো বছরে প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মসজিদটির অবকাঠামোগত কোন উন্নয়ন ঘটেনি। ৫৪ বছর বয়সী পুরাতন এ মসজিদে প্রয়োজন অনুসারে খুব একটা সংস্কারকাজও পরিলক্ষিত হয়নি, হয়নি কোন চোখে পড়ার মতো কোন পরিবর্তন।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। তারা খুব দ্রুত মসজিদটিকে আধুনিকায়ন করে নতুন রূপ দানের দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদের দেয়াল ও ছাদের বেশকিছু অংশের পলেস্তারা এবং রঙ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। দেয়ালে লাগানো লোহার গ্রিল জং ধরে গেছে। ফ্লোরের আস্তরণেরও অনেক জায়গায় ছোট-ছোট ফাটল দেখা গেছে।
এছাড়া প্রতিদিন মসজিদে আগত শতশত মুসল্লিদের ব্যবহারের জন্য আছে মাত্র অল্প কয়েকটি টয়লেট, এবং অপরিষ্কার ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণে সেগুলো ব্যবহারেরই উপযুক্ত নয়।
আর মসজিদে আযান দেয়ার জন্য মোট ৬টি মাইকের ২টিই একেবারেই নষ্ট, আর বাকি চারটা দিয়েই কোনমতে কাজ চালানো হচ্ছে। মসজিদের এক খাদেম জানান, ৪টি মাইকের সাউন্ড ভালো আসেনা, নষ্টই বলা চলে। নামাজের সময় ব্যবহৃত ভিতরের সাউন্ড সিস্টেমটাও ত্রুটিপূর্ণ বলে জানান তিনি।
তাছাড়া নামাজের জন্য যে কার্পেটগুলো বিছানো হয় সেগুলোও অনেক পুরাতন ও ময়লাযুক্ত দেখা গেছে। তাছাড়াও এক মুসল্লির ভাষায়, মসজিদের প্রবেশপথে সাধারণ পা মুছার জন্য ভাল পাপোশও রাখা হয়না, বরং এখানে রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের ছেড়া কয়েক টুকরো পাপোশ, যেগুলো থেকে পায়ে আরও ময়লা লেগে যায়।
তাছাড়া জুমার দিন মুসল্লিদের জায়গা না হওয়াতে মসজিদের বাহিরেই নামাজ পড়তে হয় অনেককে। মহিলাদের জন্য মসজিদের একপাশে নামাজের জায়গা থাকলেও সেটা খুব স্বল্প আয়তনের একটি রুম মাত্র। সেখানে মাত্র ১৪ জন লোক একসাথে নামাজ পড়তে পারে বলে মসজিদ সূত্রে জানা যায়।
জানা গেছে, এ মসজিদে কুরআন-হাদিসসহ প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০টি ইসলামিক বই ছিল। এগুলো কাঠের আলমারিতে রাখার কারণে ২০০৫ সালের দিকে কাঠ খেকো পোকা সব বই নষ্ট করে ফেলে। তারপর আর মসজিদে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের এরকম বেহাল অবস্থায় মসজিদ আধুনিকায়নের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
ঢাবির বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোজাম্মেল হক বলেন, শতবর্ষের বয়োবৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতির মূল চিত্রকে ধারণ করে। এখানকার এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদে যদি নামাজের জায়গার সংকুলান, অজুর স্থান ও শৌচাগারের জরাজীর্ণ অবস্থা হয়। তাহলে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কিভাবে ধর্মীয় উপাসনালয়ের কদর করতে হয় সেটা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় মসজিদকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় উন্নীত করে নতুন রূপে সাজাবে বলে আশা করছি।
ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসাইন বলেন, ডাকসু যখন ছিল তখনই আমরা ছাত্র অধিকারের পক্ষ থেকে সেন্ট্রাল মসজিদের সংস্কার নিয়ে কথা বলেছিলাম। এখানে মেয়েদের নামাজ পড়ার জন্য একটু জায়গা আছে, যা আসলে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প। আর সেখানে নোংরা কার্পেটে নামাজ পড়তে হতো তাদের। তখন আমাদের নিজস্ব খরচেই এই কার্পেটগুলো পরিস্কার করানো হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, আর শীতকাল আসলে এখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে নিম্নমানের কার্পেটগুলো দেয়া হয়, যেগুলোতে মুসুল্লিরা নামাজ পড়তে অসুবিধা বোধ করে। এখানে আসলে নামাজ পড়ার ফ্রেন্ডলি পরিবেশ নেই। মসজিদে সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ওয়াশরুমের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। আমরা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আগামী সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবো এবং একই সাথে আশা রাখবো শতবর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় মসজিদ আধুনিকায়নের প্রতি অবশ্যই সুদৃষ্টি রাখবে।
এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব মো. আমানুল্লাহ আমান বলেন, কালের পরিক্রমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ অতিক্রম করেছে এবং ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য স্থাপনার অবকাঠামো যুগোপযোগী করা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের কোনো সংষ্কার করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কেন্দ্রীয় মসজিদের টয়লেটগুলো থেকে দুর্গন্ধ আসে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে যেখানে স্বাস্থবিধির কোন বালাই নেই, জায়গার সংকুলান না হওয়ায় জুমা’র নামাজের সময় অনেক মুসুল্লীর মসজিদের বাইরে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। যুগে যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য স্থাপনার অবকাঠামো যুগোপযোগী করা হলেও কেন্দ্রীয় মসজিদের সংষ্কার যুগোপযোগী না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক এবং কর্তৃপক্ষের এমন আচরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাপর স্থাপনার মতো কেন্দ্রীয় মসজিদেরও অবকাঠামো যুগোপযোগী করা হোক।
কেন্দ্রীয় মসজিদের সিনিয়র ইমাম খতীব ড. সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মাস্টারপ্ল্যান প্রণীত হয়েছে সেখানে সেন্ট্রাল মসজিদ আধুনিকায়নের কথা বলা হয়েছে। কবে নাগাদ এই কাজ শুরু হতে পারে সেটি আমাদের ধারণা নেই। আশা করি খুব দ্রুত মসজিদ আধুনিকায়নের কাজ শুরু হবে, কারণ ভিসি স্যার আমাকে জানিয়েছেন সেন্ট্রাল মসজিদের কথা মাস্টার প্ল্যানের প্রথম পৃষ্ঠায়ই আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মসজিদটির সংস্কার খুবই দরকার। তবে আমাদেরও আসলে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আছে। এটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে মসজিদ সংস্কারের ব্যাপারটি খুব একটা গুরুত্ব পায়নি এবং আমরা করতে পারচ্ছি না।
“তবে এটার জন্য সকল কিছুর প্রস্তুতিই আমার ছিল। কিন্তু বেশকিছু সীমাবদ্ধতার কারণে করা সম্ভব হয়নি। মাস্টার প্ল্যানে যদিও মসজিদ আধুনিকায়নের কথা বলা আছে, কিন্তু এর বাইরেও ওই অংশটুকুর কাজ শেষ করার উদ্যোগ আমার ছিল, দুঃখজনক যে, সেটা হয়ে উঠেনি। তবে সংস্কারটা খুবই দরকার, এটি আমাদের প্রক্রিয়াধীন আছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. ওসমান গনি ও অন্যান্য প্রফেসরগণ ও শিক্ষক-কর্মকর্তা ও বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মসজিদটির ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ মসজিদটি পবিত্র রমজান মাসের এক শুক্রবারে উদ্বোধনের পর মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মসজিদের মধ্যে এটি সেন্ট্রাল মসজিদ হিসাবে গণ্য করা হয়। ৫ বিঘা জমির ওপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত। মসজিদটির দু'টি মিনার, ভিতরে রয়েছে গোলাকার বেশ কিছু পিলার, কারুকার্য খচিত দরজা-জানালা, ঝাড়বাতি নয়টি, আলমারি ২টি।
মসজিদের ভিতরে ২৩ কাতারে (লাইন) নামাজে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কাতারে ৭৫-৮০ জন মুসল্লি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে পারেন। এছাড়া মসজিদের বারান্দার অংশে রয়েছে আরো ১০টি কাতার। সেখানেও প্রতি কাতারে ৭৫-৮০ জন দাঁড়াতে পারে। প্রতি শুক্রবার মসজিদে দুই হাজারের অধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান নামাজ আদায় করেন।