জাবিতে ভর্তি ফরমের ৮ কোটি টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা, আজ যাচ্ছে ইউজিসি
শিক্ষার্থীদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক ভর্তি ফরমের দাম ৫০ টাকা বাড়ানো হয়। ওই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফরম বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ কোটির বেশি ব্যয় হয় পরীক্ষা আয়োজনে। আর দুই কোটির বেশি ব্যয় হয় অন্যখাতে। বাকি ৮ কোটি টাকার বেশি নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
বিপুল এই অর্থ নিজেদের পকেটস্থ করার বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসির তিন সদস্যের তদন্ত দল আজ বুধবার সরেজমিন তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে।
ইউজিসির গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের। অন্য দু’জন হলেন- ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. গোলাম দোস্তগীর।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, ভর্তি ফরম বিক্রির আয় নিয়ে আর্থিক অনিয়ম ও তহবিল তছরুপের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তদন্তে আমরা যাচ্ছি। রেজিস্ট্রারের কাছে জানতে চাইব-২০১৯ ২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে ভর্তি ফরম বিক্রির আয় কত, ব্যয় কত, সম্মানী কত আর বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে কত জমা রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, আর্থিক বিধিবিধান অনুসারে ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রাখতে হয়। বাকি ৬০ শতাংশ অর্থ দিয়ে পরীক্ষার সব আয়োজন, প্রশ্নপত্র তৈরি, মডারেশন, ছাপানো, পরিবহন, আপ্যায়ন, আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তা করেছে কিনা: তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।
জানা যায়, ভর্তি ফরমের বিপুল টাকা শিক্ষক কর্মকর্তাদের পকেটস্থ করার বিষয়ে পৃথক তদন্ত করছে দুদকও। গত মাসে এ বিষয়ে দুদকের পক্ষে ইউজিসিকে চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে ভর্তি আয়োজনে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্য সম্মানী কী রূপ হতে পারে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। বিগত বছরগুলোর তুলনায় ওই বছর ভর্তি ফরমের মূল্য বাড়ানো হয়। ফরমের দাম রাখা হয় ইউনিটভেদে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা; আগের শিক্ষাবর্ষে যা ছিল ৩৫০ থেকে ৫৫০ টাকা। ফরম বিক্রি থেকে সেবার প্রায় ২০ কোটি টাকা আয় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার আগের বছর এ আয় ছিল ১৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪টি বিভাগ ও ৩টি ইনস্টিটিউটে ১৮৮৯ আসনের বিপরীতে পরীক্ষায় অংশ নেন ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৬২ ভর্তিচ্ছু।
শিক্ষার্থীরা জানান, আগের বছরের চেয়ে ওই বছর বছর এ, বি, সি, ডি এবং ই ইউনিটের ভর্তি ফরমের মূল্য গত বছরের চেয়ে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া সি১, এফ, জি, এইচ এবং আই ইউনিটের ফরমের মূল্য ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগ আলাদা ফি নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কারণে একজন শিক্ষার্থীকে শুধু মানবিকের বিভাগগুলোর জন্য ফি গুনতে হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা। গত ৮ বছরে ভর্তি ফরমের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ৭২ শতাংশ। এতে চরম অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের সিদ্ধান্তকে ‘ফরম বাণিজ্য’ হিসেবে অভিহিত করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা বাবদ খরচ দেখানো হয় ৮ কোটি এক লাখ ২২ হাজার টাকা। অন্য খাতে ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিজ্ঞাপন, ভর্তি নির্দেশিকা ছাপা, পরীক্ষার সরঞ্জাম ক্রয়সহ কয়েকটি খাত রয়েছে।
তার আগের বছর ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে খরচ দেখানো হয় ৯ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিজ্ঞাপন, ভর্তি নির্দেশিকা ইত্যাদি খাতে দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়। আর শিক্ষক কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা হিসাবে দেওয়া হয় ৭ কোটি ৩১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিতে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা বাদ দিলে খরচ বেড়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। অথচ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা বেড়েছে ৬৯ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।
সূত্রগুলো জানায়, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে উপাচার্য ৩ লাখ টাকা, দু’জন উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সব অনুষদের ডিন ও ইনস্টিটিউটের প্রধান প্রত্যেকে পেয়েছেন ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। আর শিক্ষক ও প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা প্রত্যেকে পেয়েছেন ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। একদিন দায়িত্ব পালনের জন্য একজন শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়েছেন ১৪ হাজার ৫০০ টাকা করে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতার পরিমাণ আরও বেশি ছিল।
ইউজিসির তদন্ত দলের সদস্য সচিব গোলাম দোস্তগীর বলেন, ভর্তির আয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই আয়। এ বাবদ প্রাপ্ত আয়ের সব টাকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে যাবে। এরপর সুনির্দিষ্ট আর্থিক বিধিবিধানের আলোকে পদমর্যাদাভিত্তিক, নথি অনুমোদন সাপেক্ষে সম্মানী বণ্টিত হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখব।
ইউজিসির তদন্তের বিষয়ে জাবির ডেপুটি রেজিস্ট্রার এবং শিক্ষা ও ভর্তি পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব আবু হাসান বলেন, তদন্ত বিষয়ে আমি কিছু জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হয়তো জানতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন বক্তব্যে পাওয়া যায়নি। সূত্র: সমকাল