জাবির উপাচার্য নিয়োগে প্যানেল নির্বাচন দাবি
১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ অনুযায়ী দেশের স্বায়ত্ত্বশাসিত চার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। সেখানে সিনেটে উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল নির্বাচনের বিধান আছে। এ বিধান অনুসারে সিনেট সদস্যদের ভোটে উপাচার্য পদের জন্য তিনজনের প্যানেল নির্বাচিত হয়। নির্বাচিতদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য যে কোনো একজনকে নিয়োগ দেন।
এই চার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। আগামী ২ মার্চ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সিনেটরদের দাবি দ্রুততম সময়ে সুষ্ঠুভাবে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন সম্পন্ন করা।
তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, গণতান্ত্রিক চর্চা ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ক্যাম্পাসের জন্য উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সিনেট দ্বারা মনোনীত হলে শিক্ষক রাজনীতিতে ভারসাম্য বিরাজ করে। এতে শিক্ষা ও গবেষণা এবং মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের পথ সুগম হয় বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকবৃন্দ।
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরে এই চার স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার অনির্বাচিত উপাচার্যের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। যেমন জাহাঙ্গীরনগরে; উপাচার্য ফারজানা ইসলাম দ্বিতীয়বার ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে ১১(২) ধারা অনুসারে নিয়োগ পান। ফলে সে সময় প্যানেল নির্বাচন দেওয়া হয়নি।
জানা যায়, ২০১৪ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দেশের প্রথম নারী হিসেবে জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য হয়। সেসময় তিনি আওয়ামীপন্থী শিক্ষক সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ থেকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৭৩ এর ১৯(১) ধারা অনুসারে ৯৩ জন মনোনীত ও নির্বাচিত সদস্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট গঠিত হবে। অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারা অনুযায়ী যাদের দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত করে আচার্যের নিকট পাঠানো।
নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসায়, অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের প্রথম মেয়াদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ছিলো। এই মেয়াদে বিভিন্ন প্রশাসনিক পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসে। এই চার বছরের মধ্যে ২০১৫ সালের অক্টোবরে সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন, ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিন নির্বাচন, একই বছরের জুন মাসে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সিন্ডিকেট সদস্য, অর্থ কমিটি ও শিক্ষা পর্ষদে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন ও ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্রাজ্যুয়েট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তবে সময়ের পরিক্রমায় উপাচর্য ফারজানা ইসলাম ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে ১১(২) ধারা অনুসারে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পান। এরপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভিন্ন পর্ষদ যেমন ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটির নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি বহুল প্রতিশ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন গঠন পর্যন্তই থেমে থাকে। এছাড়াও ২০১৯ সালে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এতে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করে। দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগের তিন মাসের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ বেরিয়ে নতুন শিক্ষক সংগঠন গড়ে উপাচার্য। ২০১৮ সালের ৮ মে নতুন সংগঠনের নাম দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু-আদর্শের শিক্ষক পরিষদ। যার বর্তমান নাম বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ। এই সংগঠনের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার। তিনি এর আগে উপাচার্য বিরোধী আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ এর সভাপতি ছিলেন। এই সংগঠন থেকে নির্বাচন করে শিক্ষক সমিতির সভাপতিও নির্বাচিত হন তিনি। এসময় উপাচার্য বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন অধ্যাপক অজিত।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক এ কে এম শাহনেওয়াজ বলেন, নির্বাচন ছাড়াই কোন উপাচার্য দায়িত্ব পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একনায়কসুলভ আচারণ বৃদ্ধি পায়। এতে শিক্ষক রাজনীতিতে নতুন বলয় তৈরি হয়। এসময় অনেক শিক্ষক নিজের স্বার্থের কারণে দল পরিবর্তন করে। স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাস বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ফলে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। মুক্তচিন্তার চর্চা ও বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সিনেটরের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আন্দোলনের একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এতে অধিকাংশ আন্দোলন তার মূল চেতনা থেকে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। একারণে উপাচার্য যদি নির্বাচিত হয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে তাহলে ক্যাম্পাস রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্রাজ্যুয়েট প্রতিনিধি মেহেদী জামিল বলেন, একজন সিনেটর হিসেবে আমাদের মৌলিক কাজ বাজেট অধিবেশন ও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। মহামারির কারণে মাত্র একটি বাজেট অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এতেই আমাদের তিন বছর শেষ হয়ে যায়। আমরা এখনো উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন পায়নি। এটা বিশ্ববিদ্যালয়েল গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এবার সুযোগ রয়েছে। তবে এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দাবি আসা উচিত। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের পাশাপাশি ছাত্রদের জীবনমান উন্নত করতে চায়।
সর্বশেষ উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ এর প্যানেল নির্বাচনে জয়লাভ করে। এই প্যানেলে ছিলেন তৎকালীন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আমির হোসেন, তৎকালীন গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবুল হোসেন ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম।
এ বিষয়ে বর্তমান সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশকে সমুন্নত রাখার জন্য হলেও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন জরুরি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা নিশ্চিত হয়। আমাদের সবসময়ের দাবি ছিলো প্যানেল নির্বাচন। এতে সিনেট অর্থবহ হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও শিক্ষা-গবেষণার মান বজায় থাকতো।