চাওয়া মাত্রই শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিচ্ছেন রাবি ভিসি!
ট্রাকচাপায় নিহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেলের মৃত্যুর ঘটনায় সহপাঠীদের আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল পুরো ক্যাম্পাস। মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবি জানাতে থাকেন। তবে শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু সব দাবি কতদিনে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন রয়েই গেছে!
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী সাকিলা খাতুন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ট্রাক চাপায় পিষ্ট হয়ে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় প্রশাসনের একটা দায়িত্বহীনতা ছিল। যার ফলেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। তবে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সাথে যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তা অবশ্যই ইতিবাচক। তাছাড়া প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এটাও দেখার বিষয় যে, দাবিগুলো কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমরা অবশ্যই এবিষয়গুলো পর্যবেক্ষণে রাখব বলে জানান তিনি।
রাকসু আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল মজিদ অন্তর জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যন্য শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়ে আন্দোলনে নেমেছে। ফলে প্রশাসন এক প্রকার বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এ দাবি কতটা বাস্তবায়িত হবে, সেটা সময় বলে দিবে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সাথে মুক্ত মঞ্চে বসে প্রশাসনের আলোচনার বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক।
তবে এটাই তো স্থায়ী সমাধান না। আজ শিক্ষার্থীদের একটা প্রতিনিধি দল থাকার কথা ছিল, যারা সিনেটে বসে প্রশাসনের সাথে যেকোন কাজে আলোচনার মাধ্যমে তা পরিচালনা করবে। শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া গুলো প্রশাসনের কাছে পেশ করবে। কিন্তু প্রশাসন সেই পথ বন্ধ করে রেখেছে। অথচ '৭৩ এর এক্ট অনুযায়ী রাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের অধিকার।
তিনি আরও বলেন, আজ রাকসু না থাকার কারণে রাস্তাঘাটে প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া জানাতে হচ্ছে। ফলে কোন দাবি মানছে, কোনটা মানছে না প্রশাসন। তাই শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে স্থায়ী কোন সমাধান হচ্ছে না। বারবার এমন সব ঘটনা ঘটেই চলেছে। তাই স্থায়ী সমাধানে রাকসু নির্বাচন প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
তাছাড়া শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- নিহত হিমেলের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান; আহত শিক্ষার্থীর ব্যয়ভার বহন করা; হিমেলের নামে নির্মাণাধীন বিজ্ঞানভবনের নামকরণ করা; রাস্তা মেরামত করে কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করা; সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ও বহিরাগতের সম্পূর্ণ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা; কাজলা ও বিনোদপুর গেটে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা; রাকসু নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরে রাস্তা মেরামত করে কাজ চালু করা; বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের বোনকে চাকরি দিতে দেয়া, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাল্টানো, প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং হিমেল নিহতের ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিচার করতে হবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে প্রক্টরের পদত্যাগ ও ক্ষতিপূরণসহ একাধিক দাবি ইতিমধ্যে মেনে নেওয়া হয়েছে। বাকি দাবিগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া হিমেলের মৃত্যুর ঘটনায় পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার নেয়া পদক্ষেপ বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আসিফ হাওলাদার নামে আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী বলেন, হিমেলের মৃত্যুর খবর শুনেই বিভিন্ন হল শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে আন্দোলন শুরু করে। কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের যান চলাচলন বন্ধ করে দেয়। কিছু শিক্ষার্থী ভিসির বাসভনের সামনে অবস্থান নেয়। আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা বেশকিছু দাবি জানিয়েছেন। তিনি চাওয়া মাত্রই আমাদেরগুলো মেনে নিচ্ছেন। অনেকগুলো মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
এর আগে, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনের পাশে ট্রাকচাপায় নিহত হন শিক্ষার্থী মাহবুব হাবিব হিমেল। এ ঘটনায় রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি ট্রাকে আগুন দেন হিমেলের সহপাঠীরা। একই সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তুলে আন্দোলনে নামে তারা।
পরে রাত ২টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার রাজশাহী মেডিকেল থেকে বাসায় ফিরলে শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের অপসারণসহ নিহতের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ, নিহতের বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পাল্টানো এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের লিখিত দাবি জানায়।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে উপাচার্য ঐদিন রাতেই প্রক্টরিয়াল বডিকে অপসারণের মৌখিক আশ্বাস দেন। পরে বুধবার বিকেলে শিক্ষার্থীদে সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনা রাবি ভিসি বলেন, নতুন বিজ্ঞানভবন হচ্ছে আমরা সেটাকে শহীদ হিমেল বিজ্ঞান ভবন নামে নামকরণ করবো। আর যে সড়কে সে মারা গেছে তার নামকরণও হিমেলের নামে হবে। আমি ৫০ বছর ধরে এই ক্যাম্পাসে আছি। তোমরা আছো ৪-৫ বছর ধরে। তাই, আমি তোমাদের সাথে রেখেই সব কাজ করব।
রাবি শিক্ষার্থী হিমেলের মৃত্যুর ঘটনায় ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারের এসব পদক্ষেপের প্রসংশা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থীরা।
জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও রাবির সাবেক শিক্ষার্থী নাদিম মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, গত বছরে অগাস্টে গোলাম সাব্বির সাত্তার স্যার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তখন অনেক প্রত্যাশা নিয়ে বলেছিলাম, তিনি কেবল একজন উপাচার্য হিসেবে নয়, একজন অভিভাবক হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি এগিয়ে নিবেন।
তিনি লিখেন, গতকাল চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদ হিমেল নিহত হওয়ার পর আমি নজর রাখছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দিকে। মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা যখন বিক্ষোভ করছে, তখন উপাচার্য সেখানে গিয়ে সংহতি জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের সব দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ভোর না হতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরকে প্রত্যাহার করে নতুন প্রক্টর দিয়েছেন।
রাবি ভিসির প্রশংসা করে নাদিম আরও লিখেন, যারা এতোদিন ভেবেছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে হবে, তাদের সেই চিন্তাধারার চির ধরিয়েছে মতিহারের এই উপাচার্য। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করার আগে তিনি নিজেই সেই আন্দোলনে যখন শরিক হয়েছেন, তখন শিক্ষার্থীরা কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে? প্রখর বুদ্ধিমত্তায় তিনি আমার হৃদয় জয় করে ফেলছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক আরেক শিক্ষার্থী বাবুল আক্তার ফেসবুকে লিখেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর আগে কখনো এমন শিক্ষার্থী বান্ধব ভিসি পেয়েছে কিনা জানা নেই। ছাত্ররা একে একে দাবি বলে যাচ্ছে আর তিনি সাথে সাথে মেনে নিচ্ছেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসিদের শিক্ষা নেওয়া উচিত এখান থেকে।