একাধিক সাক্ষাৎকারেও যোগ্য শিক্ষক পায়নি সংস্কৃত-উর্দু বিভাগ
বার বার সাক্ষাৎকার নিয়েও যোগ্য প্রার্থীর অভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর সংস্কৃত, উর্দু ও ফার্সি বিভাগ। এসব বিষয়ে স্নাতক করেও কথা বলাতো দূরের কথা পড়তে এবং লিখতেও পারেনা শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে ১১ জন প্রার্থী আবেদন করেন। কিন্তু তাদেরকে সাক্ষাৎকার ডাকা হলে একজন প্রার্থীও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। ভর্তিযুদ্ধে লড়াই করে এ বিষয়ে পড়তে আসলেও স্নাতক শেষ করে এখন দেখা যাচ্ছে কিছুই শেখা হয়নি। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে সংস্কৃত ভাষা শেখাতে হবে। কিন্তু তারা যদি নিজেরাই না পারে তাহলে কিভাবে শেখাবে?
আরও পড়ুন- ঢাবি ছাত্রলীগের হল কমিটিতে আলোচনায় যারা
যখন ভাইভা বোর্ড সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করে, তখন একের পর এক প্রার্থী ব্যার্থ হতে শুরু করে, অবশেষে চাকরির জন্য যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন না করেই সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়া শেষ করতে বাধ্য হয় বোর্ড।
সাক্ষাৎকার বোর্ডের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড. অসীম সরকার বলেন, ‘আমরা সিলেবাস পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছি এবং শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞানের সাথে সংস্কৃক শেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পাঠ্যক্রম তৈরি করার পরিকল্পনা করেছি।’
তিনি বলেন, এটা ঠিক নয় যে কেউ সংস্কৃত পড়তে পারেনি। কেউ কেউ ভালো করেছে। আমরা আবার বিজ্ঞপ্তি দিবো এবং আশা করি আমরা যোগ্য প্রার্থী পাব।
এদিকে তিনবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেও শিক্ষক নিয়োগের যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগ। বিভাগটি ২০১৬ সাল থেকে তিনটি সার্কুলার জারি করেছে কিন্তু উর্দুতে পর্যাপ্ত জ্ঞানসহ কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষক খুঁজে পাননি তারা।
সমস্যাটি শুধুমাত্র সংস্কৃত এবং উর্দু বিভাগের স্নাতকদের জন্য উদ্বেগজনক নয়। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং পালি ও বৌদ্ধ বিষয়ে ডিগ্রীধারী অনেকেই ভাষা ভালোভাবে পড়তে বা লিখতেও পারেননা।
২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক করেছেন সামিউল, তিনি বলেন, তার ব্যাচের ৬০% শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে ফারসি ভাষায় লিখতে পারে না, তাদের পড়ার দক্ষতা আরও খারাপ।
আরও পড়ুন-‘আগে বিশেষ, পরে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি’
তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং পালি ও বৌদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগে ৩ হাজার ৭১০ জন শিক্ষার্থী এবং ১২৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। প্রতি বছর প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে গড়ে একাডেমিক খরচ দেড় লাখ টাকা, অর্থাৎ সরকার এ বিভাগ পরিচালনা করতে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো- উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, পালি এবং বৌদ্ধ অধ্যয়ন এবং সংস্কৃত বিভাগের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষার সময় বাংলায় উত্তর লেখেন। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা বিভাগ না করে তাদের নিজ নিজ ভাষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিষয়গুলো নিয়ে আসা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ বলেন, এ ধরনের বিভাগগুলো কোনো যোগ্য শিক্ষক ছাড়া অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পরিচালনা করার মতো অবস্থায় নেই। একসময় এই বিভাগগুলোতে এই ভাষাগুলির গভীর জ্ঞান সমৃদ্ধ পণ্ডিত ছিল। তাই, এই বিভাগগুলোকে বিলুপ্ত করার সময় এসেছে, যার এখন কোন প্রয়োজন নেই।
২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগে ৪৩ জন শিক্ষার্থী ছিল। তারা ২০১৮ সালে তাদের স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। তবে এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ভালো সংখ্যক গ্রাজুয়েট এখনো চাকরি পায়নি।
দুর্ভাগ্যবশত, কেউ উর্দু সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ হননি। এবং অনেক ছাত্র উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়াই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করছে।
উর্দু বিভাগের ২৫০ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর তালিকা ঘেটে দেখা যায়, তাদের মধ্যে একজনই সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় উর্দু প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়েছেন। বাকিদের বিষয়ের সাথে কোন সম্পর্ক নেই এবং কোন গবেষণাও করছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের প্রাক্তন ছাত্র শাহিন আলম বলেন, শিক্ষার্থীরা জানে যে তারা সঠিকভাবে উর্দু শিখলেও তারা চাকরি পাবে না। আর সে কারণেই তারা দ্বিতীয় বর্ষ পাশ করার পরই চাকরি সংক্রান্ত পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। আমাদের পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজিতে লেখার বিকল্পও ছিল। তাই উর্দুতে উচ্চস্তরের দক্ষতার প্রয়োজন ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটি সম্প্রতি সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং পালি ও বৌদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগে প্রথম বর্ষের অনার্সের শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ডিনস কমিটি আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ এবং ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে আসন কমানোর সুপারিশ করেছে।
আরও পড়ুন- মাদ্রাসা শিক্ষকদের জানুয়ারি মাসের এমপিওর চেক ছাড়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. মুমিত আল রশিদ বলেন, আমাদের বিভাগ প্রতি বছর ৮০-৯০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে। গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর বিভাগটি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছুক কাউকে পায় না। আসলে একসাথে ৮০-৯০ জন শিক্ষার্থীকে ভাষা শেখানো অসম্ভব। আমরা আমাদের বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও আমাদের দাবি পূরণ করতে পারেনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, বিভাগটি উর্দু ভাষার ওপর গবেষক তৈরি করার চেষ্টা করছে। উর্দু শুধু পাকিস্তানের ভাষা নয়, এর উৎপত্তি ভারতে। সুতরাং, স্নাতকদের এটির উপর গবেষণা করার সময় ভাষাটি বিকাশের সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি দেখবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে।