৫২ বছরে জাবি: গবেষণার হালচাল
- মেহেদী মামুন
- প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৫৫ PM , আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২২, ০১:৪০ PM
প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। দীর্ঘ পথ চলার সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পরিস্থিতি তুলে ধরতে ধরতে গতকাল মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক গবেষণা ইন্ডেক্স ওয়েবসাইট ‘স্কোপাস’ এর শরণাপন্ন হতে হয়। ওয়েবসাইটটি বিশ্বব্যাপী সংঘটিত গবেষণার মান বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে থাকে।
ওয়েবসাইটটির তথ্য অনুযায়ী, ৫০ বছরে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা নিবন্ধের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৯৮। ১৯৭৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। সেবছর মাত্র দুটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হয়। এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ২০২১ সালেই ৬৯২টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যা ৫০ বছরে সর্বোচ্চ ।
এছাড়া ১৯৭৫-৭৯ সালে কোন ধরণের আন্তর্জাতিক জার্নালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকাশ হয়নি। অন্যদিকে ১৯৭৪ এবং ১৯৮০-৯১ সাল পর্যন্ত গবেষণার সংখ্যা ১০টির নিচে ছিল। তবে ২০০৮ সালের পর থেকে গবেষণার সংখ্যা একশর উপর উঠতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২০১, ২০১৮ সালে ২৩০, ২০১৯ সালে ৩২০ এবং ২০২০ সালে ৪৪২টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
মোট গবেষণার মাত্র ৪ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসির অর্থায়নে
প্রকাশিত মোট নিবন্ধের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অর্থায়ন ছিলো মাত্র ৭২টিতে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে ৬৬টি। সবমিলিয়ে এর পরিমাণ মোট গবেষণার ৩.৫৪ শতাংশ মাত্র। জাপান সোসাইটি ফর দ্যা প্রমোশন অব সায়েন্স ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় অর্থায়ন করেছে যথাক্রমে ৮৮টি ও ৭৮টি তে। এছাড়াও দেশি-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগরের গবেষকদের অর্থায়ন করেছে।
অর্থায়ন হলেও প্রকাশনা হয় না
পঞ্চাশোর্ধ এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছরেই তিন শতাধিক গবেষণাতে অনুদান করে। কিন্তু সেগুলো মানসম্মত জার্নালে প্রকাশ হয়না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৩৮১টি, ২০২০-২১ এ ৩৮২টি, ২০১৯-২০ এ ৩৬৪টি ও ২০১৮-১৯ এ ৩৬৫টি গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিবছর প্রায় তিন শতাধিক গবেষণা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
কিন্তু এর বিপরীতে স্কোপাস ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২০২১ সালে ৩৩টি, ২০২০ সালে ১৬টি, ২০১৯ সালে ২টি এবং ২০১৮ সালে মাত্র ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নকৃত গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ পায়।
প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষকদের কাছে বার্ষিক বরাদ্দের অধীনে প্রকল্পের চাহিদা আহবান করা হয়। শিক্ষকদের গবেষণার প্রোপজলের চাহিদার প্রেক্ষিতে গবেষণার জন্য বার্ষিক বরাদ্দের টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। বিগত বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণা খাতে বাজেট ছিল ৩ কোটি। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৪ কোটি পাওয়ায় প্রত্যেক প্রকল্পের বিপরীতে শিক্ষকরা প্রায় এক লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছেন যা আগে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়ার পরেও ঐসব প্রকল্পের গবেষণা কোন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়নি।
গবেষকরা বলছেন, গবেষণা প্রকল্পের উদ্দেশ্য সাধিত হয় যখন সেটি ভাল মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রকল্পটির ফলাফল কোন জার্নালে প্রকাশ হলো কিনা সেটি তদারকি করা হয়না। গবেষণা শেষে নির্দিষ্ট তারিখে একটি সেমিনার হয়। সেখানে উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রকল্পের সমাপ্ত করা হয় এবং বরাদ্দের নির্দিষ্ট টাকা শিক্ষকরা পেয়ে যান। অধিকাংশ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ ও বিভাগের জার্নালে তাদের গবেষণা প্রকাশ করেন। যা শুধুমাত্র পদোন্নতির জন্য কাজে লাগে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট কিভাবে দেখে এটার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনেকটা নির্ভর করে। দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের রাষ্ট্র পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদেশিদের গবেষণার ওপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুগত মানুষ বানানোর জায়গা মনে করে তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কিভাবে শক্তিশালী হবে? তিনি গবেষণায় বাজেটের স্বল্পতা ও তদারকিকেও দায়ী করেন।
তিনি বলেন, যে বাজেট গবেষণা প্রকল্পগুলোতে দেওয়া হয় তা দিয়ে ভালো গবেষণা করা সম্ভব হয না। তাছাড়া, গবেষণায় সার্বিক তদারক বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এজন্য, গবেষণা মূল্যায়নের সময় ব্যক্তি পরিচয় গোপন রেখে মূল্যায়ন ও গবেষণার মান উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নুরুল আলম বলেন, আগে যেখানে গবেষণায় প্লেজিয়ারিজম চেকের নিয়ম ছিল না, আমরা তা নিয়ম করে বাধ্যতামূলক করেছি। আশা করি এটাও আমরা পারবো।
গবেষণা প্রকাশে পিছিয়ে কলা ও মানবিকী অনুষদ
স্কোপাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয় পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে যা মোট গবেষণার প্রায় ১২ শতাংশ। অনুষদ ভিত্তিতে সবচেয়ে কম গবেষণা হয়েছে কলা ও মানবিকী অনুষদে। গত ৫১ বছরে মাত্র ৪৮টি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রকাশ করতে সমর্থ হয় অনুষদটি যা মোট গবেষণার প্রায় ১ দশমিক ২৩ শতাংশ।
মোট গবেষণার ১০ ভাগ একজন গবেষকের
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এ মামুন ৪০০টি নিবন্ধে গবেষক হিসেবে অবদান রাখেন। যা মোট গবেষণার প্রায় ১০ ভাগ। এছাড়া, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির ২০৫টি, আইআইটি অধ্যাপক শামীম কায়সার ১২৫টি, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ ১০৩টি এবং রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শিশির ঘোষ ১০০টি নিবন্ধে অবদান রেখেছেন। সম্মিলিত হিসেবে, উল্লেখিত গবেষকগণ মোট প্রায় ২৪ ভাগ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছেন।
গবেষণা আছে শিক্ষার্থীদের, নেই বরাদ্দ
শিক্ষকদের পাশাপাশি গবেষণায় আবেদন রাখতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। জনস্বাস্থ্য ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন ৮১টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত গবেষণায় প্রায় ২ ভাগ অবদান রেখেছেন।ইতোমধ্যে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের তালিকায় নাম এসেছে আব্দুল্লাহ আল মামুনের। তবে, শিক্ষকদের জন্য গবেষণায় অনুদান থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো বরাদ্দ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক নুরুল আলম বলেন, গবেষণায় উৎসাহ দিতে অনুষদভিত্তিক অ্যাওয়ার্ড চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদেরকেও গবেষণায় উৎসাহী করে তোলা হবে।
১৯৭০-১৯৭১ শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যান-এই চারটি বিভাগে ভর্তিকৃত (প্রথম ব্যাচে) ১৫০ জন ছাত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ উদ্বোধন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন বিশিষ্ট রসায়নবিদ অধ্যাপক ড. মফিজ উদ্দিন আহমদ।