৫২ বছরে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়
৫১ বছর পেরিয়ে ৫২ বছরে পদার্পণ করেছে সবুজ গাছগাছালির বুক চিড়ে লাল ইটের তৈরি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। ১৯৭১ সালের এই দিনে (১২ জানুয়ারি) দেশের শতভাগ আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি।
প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে বর্তমান উপাচার্যের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারলেও এখনো নানা সংকটে জর্জরিত। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সব সংকট অচিরেই দূর হবে।
ঢাকার অদূরে সাভারে প্রায় ৭০০ একর জায়গা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এর উত্তরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, উত্তর-পূর্বে সাভার সেনানিবাস, দক্ষিণে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং পূর্বে ডেইরি ফার্ম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা উঁচু করে আছে। গ্রিক থিয়েটারের আদলে নির্মিত মুক্তমঞ্চ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার সূচনা হয় ওই ক্যাম্পাস ঘিরেই।
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চারটি বিভাগে ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছয়টি অনুষদে ৩৪টি বিভাগ এবং চারটি ইনস্টিটিউটে ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ও ৭৫০ জন শিক্ষক রয়েছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সংকটে আটকা এই বিশ্ববিদ্যালয়। ৫০ বছর পার করলেও এখনো হতে পারেনি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা পাননি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। সেশনজট, আবাসন সংকট, মাদক, র্যাগিং সমস্যা, শিক্ষক-শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা, গ্রন্থাগারে আসন সংকট, পরিবহনের অপ্রতুলতা, নামমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র, গবেষণায় অনগ্রসরতা, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজের ধীরগতি, অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিত্যক্ত সুইমিংপুল, শিক্ষকদের রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ছাত্রসংগঠনগুলোর হল দখল, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব না দেওয়া, বিভিন্ন বিভাগে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংকট ইত্যাদি কারণে কাক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়টি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। প্রতিষ্ঠার পর সমাবর্তন হয়েছে মাত্র পাঁচটি।
তবে বর্তমান সরকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১৪৪৫ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় ২০১৮ সালে।
এই প্রকল্পের আওতায় ১০০০ আসন বিশিষ্ট ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য ৩টি করে ১০ তলা মোট ৬টি হল, ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন, বিভিন্ন হলের হাউজ টিউটরদের জন্য ১০ তলা ১টি বাসভবন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের উত্তর ব্লকের ৪র্থ ও ৫ম তলা নির্মাণ, ১০ তলা বিশিষ্ট একটি প্রভোস্ট কমপ্লেক্স, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য ১টি করে ১১ তলা আবাসিক টাওয়ার, তৃতীয় শ্রেণি, চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ও পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জন্য ১টি করে ১১ তলা আবাসিক টাওয়ার, ১০ তলা ১টি গেস্ট হাউজ কাম পোস্ট গ্রাজুয়েট গবেষক হাউজ, জীববিজ্ঞান অনুষদ, কলা ও মানবিক অনুষদ ভবন, ৬ তলা একটি লেকচার থিয়েটার এবং পরীক্ষা হল, ৬তলা ১টি লাইব্রেরি ভবন এবং ৩ তলা ১টি স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মিত হবে। এছাড়াও, প্রকল্পটিতে ১টি মিনিবাস, ১টি ডাবল কেবিন পিক-আপ, ২টি এ্যাম্বুলেন্স, ক্যাম্পাসে থাকবে একটি রোড নেটওয়ার্ক, যার মাধ্যমে ১৫ মিনিট অন্তর গাড়ি চলবে। নতুন ৬টি হল নির্মিত হলে ক্যাম্পাসে আবাসিক হলের সংখ্যা দাঁড়াবে ২২।
এসব কাজ শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল বদলে যাবে ঠিকই তবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও থেকে যাবে নানাবিধ সমস্যা।
শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা সেশনজট। অধিকাংশ বিভাগেই রয়েছে সেশনজট। বিভাগীয় শিক্ষকদের সমন্বয়ের অভাবে বেশির ভাগ বিভাগে এই সেশনজট সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সান্ধ্যকালীন ক্লাস নিতে বেশি সময় ব্যয় করছেন। সঠিক সময়ে ক্লাস ও পরীক্ষা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করায় স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করতে অনেক বিভাগের সাত থেকে সাড়ে সাত বছর লেগে যাচ্ছে।
এছাড়া শিক্ষা-গবেষণায় এখনও পিছিয়ে রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আগ্রহ থাকলেও নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত অর্থায়ন। তবে সম্প্রতি নিজেদের অর্থায়নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণা করছেন। ফলে ২০২১ সালে গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বেশি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, গবেষণায় আগ্রহীদের অর্থায়ন করলে তারা গবেষণা করতে আরও আগ্রহী হবে। এছাড়া যারা গবেষণা করেন তাদেরকে সম্মাননা প্রদান করলে অন্যরাও গবেষণায় আগ্রহী হবে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা ইন্ডেক্স ওয়েবসাইট ‘স্কোপাস’র তথ্য মতে, ১৯৭৪ থেকে ২০২২ সালের ১১ই জানুয়ারী পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোট ৩৮৯৮টি গবোষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গত ৫১ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি ৩০৩০টি গবেষণা প্রবন্ধ, ৫০০ কনফারেন্স পেপার, ১৫৫রিভিউ পেপার, ৯৭টি বুক চাপ্টার ছাড়াও গবেষণা চিঠি, বই, ডাটা পেপার এবং ইরেটাম প্রকাশ করেছে। এছাড়া মোট ৩৮৯৮টি নিবন্ধের মধ্যে মাত্র ৩টি নিবন্ধ ফলাফলজনিত কারণে বাতিল বলে গণ্য হয়েছে। এছাড়া মাত্র ৭২টি গবেষণায় অর্থায়ন করেছে বিশ্ববিদ্যায়টি।
গত ৫১ বছরে সবচেয়ে বেশি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে। এ বছর ৬৯২টি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৩টি গবেষণায় অর্থায়ন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া ১৯৭৫-৭৯ সালে আন্তর্জাতিক জার্নালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন গবেষণা প্রকাশিত হয়নি। অন্যদিকে ১৯৭৪ সাল এবং ১৯৮০-৯১ সাল পর্যন্ত গবেষণার সংখ্যা ১০টির নিচে ছিল। তবে ২০০৮ সালের পর থেকে গবেষণার সংখ্যা একশর উপর উঠতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২০১, ২০১৮ সালে ২৩০, ২০১৯ সালে ৩২০ এবং ২০২০ সালে ৪৪২টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
গবেষণার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক জার্নাল ফিজিক্স অব প্ল্যাজামাতে (১১৫টি)। এছাড়া জার্নাল অব ওরগানোমেটালিক কেমেস্ট্রিতে ৯৬টি এবং এডভান্সেস ইন ইন্টিলিজেন্ট সিস্টেম এন্ড কম্পিউটিংয়ে ৪৫টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গবেষণার জন্য আগ্রহী, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা এবং সেটার জন্য কার্যকারীতা থাকতে হবে। প্রথমত, রাষ্ট্র বা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে দেখতে চায় সেটার ওপর গবেষণা অনেকটা নির্ভর করে। আমাদের দেশে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে তার সমর্থক গোষ্ঠী তৈরির কারখানা হিসেবে। তার প্রতি অনুগত শিক্ষক-শিক্ষার্থী থাকবে। তাদের রাজনৈতিক প্রভাব নিশ্চিত হবে এমন প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে যতটুকু গবেষণার সুযোগ থাকা উচিত সেখানেও উদ্যোগের অভাব আছে। এছাড়া পঞ্চাশ বছরেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কোন নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষা ও গবেষণায় আগ্রহীদের প্রাধান্য নিশ্চিত করা। কিন্তু এখানে শিক্ষা ও গবেষণায় যাদের আগ্রহ নাই তাদেরকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তারা বেশ ক্ষমতাবান। তাদেরকে সরকার ও প্রশাসন তাদের অনেক পছন্দ করে। এধরনের লোকজন যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে এখানে শিক্ষা ও গবেষণার কোন ভবিষ্যত নাই।
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট তৎকালীন সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার পূর্ব নাম জাহাঙ্গীরনগরের সঙ্গে মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার আ্যাডমিরাল এসএম আহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রাখা হয়। তবে ২০০১ সাল থেকে এ দিনটিকে “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস” হিসেবে পালন করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সব অনুষ্ঠান অনলাইনে
দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল ১০টায় জাতীয় পতাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিজনেস স্টাডিজ চত্বরে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। এরপর বেলা ১১টা ০৫ মিনিটে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ১১টা ৩৫ মিনিটে একক পরিবেশনা, ১১টা ৫০ মিনিটে রঙ্গন-মাইম একাডেমি পরিবেশিত মূকাভিনয়, ১২টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশের পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিবেশনায় পুতুল নাট্য মঞ্চায়ন হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনলাইনে জুমে অংশগ্রহণ করতে পারবে। লিংক ও জুম আইডি (অনুষ্ঠানের লিংক : https://bdren.zoom.us/s/7968013991 আইডি : 7968013991)।