চৈতির মৃত্যু নিয়ে রহস্য, খুন নাকি আত্মহত্যা?

চৈতি সাহা
চৈতি সাহা  © ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা চৈতি সাহা লেখালেখি করতেন ‘চৈতি চন্দ্রিকা’ নামে। মৃত্যুর দু’দিন আগেও ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছিলেন— বন্ধুর বিয়েতে তোলা হাসিমাখা নিজের ছবি। পরদিনই নিজ ঘরে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় হতবাক পরিচিতজনরা। আর তার মরদেহে রক্তের দাগ থাকায় তার মৃত্যু নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। আত্মহত্যা নাকি খুন— এমন প্রশ্নই ঘুরছে তাদের মনে।

সবার মনে প্রশ্ন— হাসিখুশি লড়াকু এই মানুষটা হঠাৎ করে কেন আত্মহত্যা করবেন? যিনি সবসময় নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পক্ষে লড়াই করেছেন, লেখালেখিতে সবসময় বেঁচে থাকাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন— তার মৃত্যুর ঘটনাকে আত্মহনন বলে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তাদের।

গত রবিবার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুরের দিকে ঝিনাইদহের আদর্শপাড়ায় পাখি ডাক্তারের গলির এক বাসা থেকে চৈতির মরদেহ উদ্ধার হয়। ঝিনাইদহ সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাজী ইউনুস আহমেদ জানান, এ ঘটনায় চৈতির মা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন।

ঝিনাইদহে চৈতি সাহার এক বন্ধু বলেন, শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় আমাদের আরেক বান্ধবীর বিয়ে ছিল। অনুষ্ঠান থেকে একসঙ্গে ফিরেছিলাম আমরা। আমাদের বাড়িতেই কিছুক্ষণ কাটিয়ে ও বাড়ি গিয়েছিল। ওই সময় ক্যারিয়ার, পড়ালেখা এসব নিয়ে কথা হয়। টানা তিন দিনের ব্যস্ততার পর রবিবার দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলাম। দুপুরের দিকে উঠে বাড়ির বাইরে যেতেই ফোনে খবর পাই। চৈতির বাসায় গিয়ে দেখি ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ঝুলছে চৈতি। নাক-মুখ, মাথার পেছন দিকে রক্ত দেখতে পাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ পর্যন্ত একই স্কুল-কলেজে চৈতির সঙ্গে পড়ালেখা তার ওই বন্ধুর। চৈতির মরদেহ দেখার পর মুষড়ে পড়েছেন। ‘এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না চৈতি এমন কিছু করেছে। যে মেয়ে সামান্য মাথা ব্যথা হলেও আমাকে জানাত, যে মেয়ে আগের দিনও ক্যারিয়ার-পড়ালেখা নিয়ে এত কথা বলল সে হঠাৎ কেন এমন করবে— কিছুতেই বুঝতে পারছি না,’— বলেন চৈতির ওই বান্ধবী।

এসআই কাজী ইউনুস আহমেদ জানান, চৈতির এক আত্মীয়ের ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং থেকে ঝোলানো অবস্থায় চৈতির মরদেহ দেখেন তারা। মাথাটা ডান দিকে বাঁকানো ছিল। নাক থেকে রক্তের ধারা বের হয়ে কানের পাশ দিয়ে পিঠ হয়ে কোমর পর্যন্ত পৌঁছেছে। মরদেহ নামানোর পর মৃতের শরীর মহিলা পুলিশ ও স্থানীয় নারীদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে শরীরে আর কোনো ক্ষত বা রক্তপাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

এসআই আরও জানান, ময়নাতদন্তের পর চৈতির মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এখনো পুলিশের হাতে আসেনি।

পারিবারিক কলহের জের ধরে চৈতি হত্যার শিকার হয়ে থাকতে পারে— সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ধারণার কথা প্রকাশ করেছেন চৈতির পরিচিত অনেকেই। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এসআই ইউনুস বলেন, এ ধরনের কোনো আমরা পাইনি।

“প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, মেয়েটি ফ্ল্যাটের মূল দরজা আটকে নিজ ঘরে ফাঁস দেয়। দুপুরে ছাদ থেকে ফিরে ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পেয়ে প্রতিবেশীদের ডাক দেন মেয়েটির মা। পরে তাদের সহায়তা নিয়ে হাতুড়ি দিয়ে দরজার ছিটকিনি ভেঙে ঘরে প্রবেশ করেন মা-বাড়িওয়ালাসহ অন্যরা।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেন চৈতির মৃত্যু নিয়ে এত আলোচনা? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হলেও নারী অধিকার নিয়ে লেখালেখি করায় অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল চৈতির। তারা বলছেন, মা-বাবার বিচ্ছেদের পর চৈতির মা ধর্ম পরিবর্তন করে অন্য ধর্মের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন। সেই সংসারে চৈতির মা ও ছোট বোন চৈতিকে ধর্ম পরিবর্তনের জন্য অনেক চাপ দিত। চাকরি নিয়ে হতাশার মধ্যেই কিছু টাকা-পয়সা জমলে বিদেশে সেটেলড হওয়ার কথাও ভাবত চৈতি।

চৈতির ঘনিষ্ঠজনেরা আরও বলছেন, ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন চৈতি। বেশ অনেক দিন ধরেই পাবনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপককে দেখাতেন তিনি। নিচ্ছিলেন থেরাপি, খাচ্ছিলেন সিডেটিভ জাতীয় ওষুধ। ফোনে বা মেসেজে তাদেরকে এসব কথা জানিয়েছেন চৈতি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চৈতির ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু বলেন, মেয়েটি আমার কয়েক বছরের ছোট। ক্যারিয়ার, পরিবার নিয়ে নিজেই সবসময় ডিপ্রেশনে থাকতেন আত্মহত্যার প্রবণতাও ছিল বলে মনে হয়েছে। কিন্তু আমাকে সবসময় মানসিক শক্তি জোগাতেন। আমাকে ডিপ্রেশন থেকে বের করার চেষ্টা চালাত। সেই মেয়ে এভাবে চলে যাবে, ভাবতেই পারছি না।

তিনি আরও বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে ঢাকায় থেকে চাকরির চেষ্টা করছিলেন চৈতি। এর মধ্যেই করোনার ধাক্কায় টিকে থাকার অবলম্বন টিউশনি চলে যায়। বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে যান। তারপর থেকেই চৈতি মানসিকভাবে অনেক বেশি ভেঙে পড়েন। তবে খুব আশাবাদী ছিলেন, সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী ছিলেন না বলেই মনে করতাম। তাই সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিতেন। এ বছরের ৬ জানুয়ারিও মেসেজ করেছিল, ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন।

চৈতির আরেক বন্ধু মুম্মিতুল মিম্মা। তিনিও জানতেন চৈতির ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভোগার কথা। তিনি বলেন, মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি না পাওয়া নিয়েও হতাশা ছিল চৈতির। ভালো ছাত্রী ছিল বলেই এ নিয়ে চাপটা বেশি আসত ওর ওপর। তবে অনেক কষ্ট আর হতাশা লুকিয়েই চৈতি হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতেন। সরকারি চাকরির জন্যও চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। সবশেষ বিসিএস পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এলে চৈতি আমার বাসাতেই উঠেছিলেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী আর ইতিবাচকই দেখেছিলাম ওই সময়।

ছেলেবেলা থেকেই মেধাবী চৈতি সবসময় ভালো ফলাফল করতেন। স্কুল-কলেজে রোল সবসময় এক থেকে পাঁচের মধ্যে থাকায় এলাকায় ভালো ছাত্রী হিসেবে সুনাম ছিল। বিজ্ঞানের ছাত্রী চৈতি ২০০৯ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ ও ২০১১ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৪.৫০ অর্জন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ভর্তি হন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারছিলেন, যা তাকে হতাশায় ফেলে দেয় বলে জানান চৈতির ছেলেবেলার বান্ধবী।

তিনি বলেন, একসঙ্গেই বিভিন্ন চাকরির চেষ্টা করতাম। আলাপ-আলোচনা ছিল ভবিষ্যৎ ঘিরে। দুই বান্ধবীই একে অন্যকে বোঝাতাম, আমাদের মেধা আছে, পড়ালেখা করলেই ভালো করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, শনিবার আমাদের আরেক বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে আমাদের বাড়িতে বসেই সামনের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে আলাপ করেছি। আগামী বিসিএস আরও ভালোভাবে পড়ে দেওয়ার কথাও জানিয়েছিল চৈতি। এর মধ্যেই চৈতি যে সবকিছু শেষ করে দিয়ে চলে যাবে, ভাবতেও পারছি না।

চৈতির ওই বান্ধবী বলেন, ওর মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়িতে গেলে চৈতির মা আমাকে দেখে বলেনর— সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে গেছে তোমার বান্ধবী।

চৈতি সাহার প্রতিবেশী ও ঝিনাইদহ জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিনা সেলিম বলেন, সেদিন সকালে মায়ের সঙ্গে রাগারাগি হয়েছিল তার। ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন চৈতি। এসময় মেয়েকে ঠেকানোর জন্য মা ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে ছাদে চলে যান কাপড় তুলতে ও মেয়ের মাথা ঠান্ডা হওয়ার সময় দিতে। ফিরে এসে দেখেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এসময় বাড়িওয়ালা ও অন্যান্য প্রতিবেশীদের জড়ো করে ছিটিকিনি ভেঙে ভেতরে ঢুকে মেয়ের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান।

তিনি আরও বলেন, চৈতি বেশ জেদি আর অভিমানী ছিলেন। ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাও কাজ করত। মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ, মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে, ধর্মান্তর ও তাকে জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করতে চাওয়ানো নিয়ে অশান্তি ছিল। মেধাবী মেয়েটি চাকরির অনেক চেষ্টাও করছিলেন। মাস দুই আগেও চৈতির মা মেয়েটির চাকরির জন্য তার কাছে এসেছিলেন। এখন বড় মেয়ের এভাবে চলে যাওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন বলে জানালেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ