‘জগন্নাথ হল ট্রাজেডি’র শঙ্কা ঢাবির আরেকটি হলে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের অধিকাংশ রুমই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এসব রুমের ওপরের পলেস্তরা ফেঁটে গেছে, অল্প একটু আঁচ পেলেই খসে পড়তে পারে যেকোনো সময়। ঘটতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যথাসময়ে সংস্কার করা না হলে পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে জগন্নাথ হলের সেই ট্রাজেডির। এমন শঙ্কাই প্রকাশ করছেন হলটি আবাসিক শিক্ষার্থীরা।
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক `শুকতারা` দেখছিলেন জগন্নাথ হলের কয়েক শত শিক্ষার্থী। হঠাৎ করেই ধসে পড়ে টিভি রুমের দুর্বল ছাদ। ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৩৮ জন। পরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯-এ।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এরকম ঘটনা থেকেও শিক্ষা নিয়ে মুহসীন হল সংস্কারে প্রশাসনের দেখা যাচ্ছে না কোন অগ্রগতি। যদিও হল খোলার পর মূল ভবনের চার থেকে ছয় তলার কিছু রুমে ভেঙে পড়ার মত পলেস্তরা ছাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু নতুন করে প্লাস্টার করা হয়নি এখনো। তাছাড়া অধিকাংশ রুমের উপরের আস্তরণ ছাড়ানো এখনো বাকি আছে। প্রতিনিয়ত পলেস্তরা খসে পড়ার ঘটনার কারণে হলের শিক্ষার্থীরা এখন এক ধরণের আতংকে সময় পার করছেন।
গত ১১ ডিসেম্বরে ওই হলের ১০৬ নাম্বার রুমের উপর থেকে প্রায় ১৫ কেজি ওজনের পলেস্তারা (আস্তরণ) ভেঙ্গে পড়েছিল। এতে অল্পের জন্য রেহাই পেয়েছিল নজরুল ফরায়জী অপু নামের এক শিক্ষার্থী। অপু ছাড়াও ওই রুমে এমআইএস বিভাগের আফজালুর প্রীতম, ফার্সি ভাষা ও সংস্কৃতির শাহীন আলম এবং ইতিহাস বিভাগের মামুন নামের তিনজন শিক্ষার্থী থাকতেন। তাদের অধিকাংশই রুমে না থাকাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি।
গত ২৪ ডিসেম্বর চতুর্থ তলার ৪(ক)নং রুমের এক্সটেশনের পানির পাইপ লিক হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পানি ঝরে শিক্ষার্থীদের বই, ব্যাগ, সার্টিফিকেট ভিজে যায় এবং উপরের জরাজীর্ণ ছাদ ভিজে পলেস্তরা খসে পড়ে। ওই রুমে মোট ৩১ জন শিক্ষার্থী থাকেন।
সবশেষ গতকাল সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) হলের ৬৬৩ নাম্বার রুমে রাত তিনটার দিকে ঘুমানোর সময় উর্দু বিভাগের আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তানভীর নামের এক শিক্ষার্থীর পাশে বড় আকারের পলেস্তরা ভেঙে পড়ে। এতে অল্পের জন্য রেহাই পান তিনি।
এ বিষয়ে তানভীর বলেন, রুমে শুয়ে আছি। আনুমানিক রাত তিনটার দিকে হটাৎ ধপাস করে একটা শব্দ হয় আর মশারি দঁড়ি ছিড়ে যায়। তারপর লক্ষ্য করে দেখি, উপর থেকে ছিটকে পড়া পলেস্তারা মশারির ওপর সজোরে পড়ার কারণে দঁড়ি ছিড়ে গেছে। শুধু এক জায়গায়ই নয়, একই সাথে চেয়ারের উপরও পলেস্তারা খসে পড়ে।
তার পূর্বের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে ওই ছাত্র বলেন, এর আগেও কয়েকটি বড় আকারের পলেস্তারা খসে পড়ার ঘটনার ভুক্তভোগী ছিলাম আমি। প্রতিবারই অল্পের জন্য বড় ধরণের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। এসব ব্যাপারগুলো হল কর্তৃপক্ষকে দুইবার করে বলার পরও অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে তারা বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাননি। এখন আর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করি না, তাদের নিকট এটার যথাযথ সমাধান চাই।
হলের প্রথম বর্ষের ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী মির সাদিক আহাম্মেদ বলেন, নিজের রুমে সবসময় খুব আতংকের মধ্যেই থাকি। কখন ছাদ ধসে পড়ে, রাতে ঘুমিয়ে সকাল দেখতে পারবো কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হয়ে গিয়েছে। বড় মাপের ভূমিকম্পে হল টিকে থাকবে কিনা এ ভয়ে থাকি সবসময়। প্রশাসনের কী উচিত নয়, হলের ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া? এখন সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে জগন্নাথ হলের ট্যাজেডির শিকার হতে হবে আমাদের। শিক্ষার্থীদের প্রাণ কী মূল্যহীন? আমাদের মুহসীন হল অন্যতম পুরাতন হল, এই হলের সংস্কারের চেয়ে নতুন ভবন নির্মাণ জরুরি বলে আমি মনে করি।
শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের মিরাজ উদ্দিন সিফাত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে যে ট্রাজেডি হয়েছিলো, তা আমরা আর চাই না এবং আমরা শান্তিতে হল জীবন পার করতে চাই। মুহসীন হলে এমন এমন রুম আছে, যেখানে জান হাতে নিয়ে ঘুমাতে হয়, সকালে উঠতে পারবো নাকি তা নিয়ে আমরা অনিশ্চিত। ২/৩ কেজির কংক্রিট প্রায়ই ক্ষয়ে পড়ছে। ওই কংক্রিট মাথায় পড়লে, বাঁচতে পারবো না। এমন আর কালো দিন আমরা আর পালন করতে চাই না। এই কালোদিন আসার আগেই আমরা চাই এর সুষ্ঠু সমাধান চাই। প্রাণ নিশ্চিত খুবই জরুরি। পত্রিকা রুম ও রিডিং রুমেও ভয় নিয়ে পড়তে হয়।
দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের মুহসীন হলের রুমগুলো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ এটা সবাই জানে। কিন্তু আরেকটি সমস্যা হল, হলের দুইটা লিফটের একটা একদমই নষ্ট। আর অন্যটিও অনেক আগের হওয়াতে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। নষ্ট লিফট কেন ঠিক করা হচ্ছে না, এ ব্যাপারে অতি দ্রুত প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
কবে নাগাদ সংস্কারের কাজ শুরু হবে, তা জানতে চাইলে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মাসুদুর রহমান বলেন, আমরা এ ব্যাপারে সজাগ আছি। আমি অলরেডি রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের ট্রেজারার মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি। ফান্ডিং সেট করা হয়েছে এবং ওই টাকাটা হল প্রশাসন পেলেই আমরা কাজ শুরু করব। আর যদি কোন রুম ঝুঁকিপূর্ণ থাকে তাহলে আমার অফিসের লোকদের বলে দিয়েছি, তারা যেন তাৎক্ষণিকভাবে ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমানোর চেষ্টা করেন।