অপুর মৃত্যু রহস্য কী?

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী (অপু)
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী (অপু)  © ফাইল ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী (অপু) এর মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকার একটি মেস থেকে সোমবার দুপুরে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, নিহত অপুর হাঁটু মেঝেতে স্পর্শ করা এবং তার দেহ ঝুলছিল। নিহতের বন্ধু ও স্বজনদের সন্দেহ, তাকে হত্যা করে পরে ফাঁস দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বলছে তদন্ত শেষে নিশ্চিত হওয়া যাবে- এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা।

অন্যদিকে, অপুর শিক্ষক-সহপাঠীদের অনেকে বলছেন তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কীভাবে তার মৃত্যু হলো সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় তার শিক্ষক, সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেছেন।

পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার অভিযোগ শিক্ষকের বিরুদ্ধে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন মাসুদ আল মাহাদী। বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরীক্ষায় নম্বর কম দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ভালো ফলাফল করলেও সে বিভাগের শিক্ষক হতে পারবে কিনা এ নিয়েও অনেক হতাশ ছিলেন অপু।

বিষয়টি নিয়ে তার বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক বলেন, অপু অনার্সে থার্ড হয়েছিল। অনার্সের রেজাল্টের পর একদিন অপুকে বললাম, মাস্টার্সের এক বছর বাড়তি একটু মনোযোগ দিলেই তুমি প্রথম হতে পারবা। সে বললো, আমি তো প্রথমই হতাম অনার্সে। হিসেব করে দেখেছি, একজন মাত্র শিক্ষক সেই প্রথম বর্ষ থেকে যে পরিমাণ কম নম্বর দিয়ে আসছেন, ওনার কোর্সে এভারেজ নম্বর পেলেই প্রথম হতাম।

অধ্যাপক ফাহমিদুল বলেন, সে সিস্টেমের বঞ্চনার শিকার। আমাদের সিস্টেম অপুদের হতাশ হতে বাধ্য করে। সেই সিস্টেম, সেই শিক্ষককে আরো বেশি ক্ষমতাবান করেছে পরে। অপু পৃথিবীকে তার নিজের যোগ্য মনে করেনি। তাই সে অন্য কোথাও চলে গেল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন অপু। থাকতেন মাস্টার দা সূর্যসেন হলে। গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। বাবার নাম হুমায়ুন কবির। তার ছোট ভাই ফয়সালও ঢাকাতেই থাকে। অপু যে কক্ষে থাকতেন সেখানে আরও দুইজন থাকতেন। তাদের একজন আল ইমরান এবং অন্যজন জহিরুল ইসলাম।

অনেকেই বলছেন আত্নহত্যার কারণ হতাশা
তার সহপাঠী ও পরিচিতজনদের মাঝে অনেকেই বলছেন হতাশায় সে আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। মোহাইমিন পাটোয়ারী নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ছেলেটি পড়াশোনাতে ভালো ছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ ক্যাম্পাসের নানা যৌক্তিক আন্দোলনে সব সময়ই পাশে ছিল! কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো।

অপুর বিভাগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মীর আরশাদুল হক বলেন, সে আমাদের ফার্স্ট বয় ছিল। তার মতো মেধাবী ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই কম। তার কিছুটা আর্থিক সংকট ছিল। কিন্তু চলার জন্য যতটুকু লাগে, তা ছিল। চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিল, এটা তো একটু লম্বা প্রক্রিয়া। সে ক্ষেত্রে হতাশা থাকতেই পারে, কিন্তু এতটা না যে তার জন্য সে আত্মহত্যা করতে পারে।

বন্ধুর সাথে অপুর শেষ দেখা
অপুর বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আবু সাঈদ একই ভবনে থাকতেন। তিনি ঘটনার দিন দুপুর বারোটায় স্কচটেপ আনতে যান অপুর রুমে। তিনি বলেন, অপু তখন শুয়ে মোবাইল টিপছিলো। বললাম, এতোক্ষণ ঘুমিয়ে আছিস কেন? সে বলে, কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি তাই ঘুম আসছে। এরপর আমি তার রুম থেকে স্কচটেপ এনে আমার রুমে এসে কাজ শেষ করে আবার তার রুমে গিয়ে দিয়ে আসি। এরপর আমি আমার রুমে চলে আসি।’

সাইদ বলেন, আমি চলে আসার পর দুপুর ২টার দিকে তার রুমমেট জহিরুল আমাকে বলে, সাইদ ভাই এদিকে আসেন তো, অপু ভাইয়ের কী যেন হয়েছে। এসে দেখি দরজা বন্ধ। দরজার উপরে একটি ছোট জানালা আছে, সেটি দিয়ে দেখি গামাছায় ঝোলানো। এরপর ৯৯৯ নাইনে ফোন দেই। আশেপাশের লোকজনকে ডেকে দরজা ভাঙি।

আবু সাঈদ বলেন, ওর আত্মহত্যা করার কোনো কারণ দেখি না আমি। চাকরি পাওয়া নিয়ে কিছুটা হতাশা ছিল। কিন্তু আত্মহত্যা করার মত কিছু দেখিনি। ও কোনো কিছুতে এডিক্টেডও ছিল না।

প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিসিএস লিখিত পরীক্ষার
অনার্স ও মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করা অপু কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। এরপর সাংবাদিকতা ছেড়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিসিএসের। সর্বশেষ ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

অপুর রুমমেট জহিরুল ইসলাম বলেন, অপু গত রাতে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, পড়ালেখাও করেছেন রাত ১টা পর্যন্ত। আত্মহত্যা করার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।

ঘটনাস্থলে পুলিশের বক্তব্য
ডিএমপির লালবাগ জোনের ডিসি জসীম উদ্দীন মোল্লা বলেন, ‌মেসের সদস্যরা বলেছেন তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে আমরা লাশের সুরতহাল করছি। সুরতহালের পর ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে। এরপর পরিষ্কার হবে যে তিনি ঠিক কীভাবে মারা গেছেন। তার ওপর ভিত্তি করে এবং আনুষঙ্গিক-পারিপার্শ্বিক সবকিছু দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ঘটনাস্থল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। তদন্ত শেষে আমার নিশ্চিত হতে পারব- এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা।

সাংবাদিকতা বিভাগের শোকবার্তা
অপুর মৃত্যু নিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। বিভাগটির চেয়ারম্যান স্বাক্ষারিত এক শোকবার্তায় বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহানী অপুর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বিভাগের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করছে।

আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি যেন মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁদেরকে ধৈয্যের সঙ্গে এই শোক সহ্য করার সাহস যোগান।

মাসুদ আল মাহাদী বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পড়াশোনা শেষ করেন।

ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে অপুর জানাজা
আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অপুর জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে জানাজার নির্দিষ্ট সময় এখনও ঠিক করা হয়নি। জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে।


সর্বশেষ সংবাদ