চলচ্চিত্র নির্মাণ বা সরকারি চাকরি কোনোটাই হলো না অপুর
নতুন ধারার চলচ্চিত্র কিম্বা সরকারি চাকরি কোনোটাই করা হলো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদীর (অপু)। ভালো ফল নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে স্বপ্ন দেখে ছিলেন নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের। কিন্তু সেই স্বপ্নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক সমস্যা। তাই সেখান থেকে সরে গিয়ে সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন।
বছর খানেকের অক্লান্ত প্রস্তুতির পর সম্প্রতি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় ভালো ফল করছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর চাকরিটা আর করা হলো না। সব মিলিয়েই হতাশ হয়ে পড়ে ছিলেন অপু। ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছিলেন তার ফেইসবুক আইডি। এমনকি কারো ডাকেও সাড়া দিতেন না।
সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বেলা দুইটার কিছু পর রাজধানীর চানখাঁরপুলের বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের উল্টো পাশে অবস্থিত একটি ভবনের আটতলার একটি কক্ষ থেকে ফ্যানের সঙ্গে গামছা দিয়ে প্যাঁচানো অপুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
অপু ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তিনি মাস্টারদা সূর্যসেন হলে থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠিতে। অপু বিভাগে ভালো ফল করার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ন্যায়সংগত আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অপুর বিভাগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মীর আরশাদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সে আমাদের ফার্স্ট বয় ছিল। তার মতো মেধাবী ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই কম। তার কিছুটা আর্থিক সংকট ছিল। কিন্তু চলার জন্য যতটুকু লাগে, তা ছিল। চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিল, এটা তো একটু লম্বা প্রক্রিয়া। সে ক্ষেত্রে হতাশা থাকতেই পারে, কিন্তু এতটা না যে তার জন্য সে আত্মহত্যা করতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত ফাহাদ তার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘শেষবার অপুর সঙ্গে উদ্যানের গেটে দেখা হয়েছিল। অনেক তাড়া ছিল তার। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবির মিছিলে অপু ছিল সামনের সারির একজন। হয়তো এইটা আত্মহত্যা বলেই চালিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবনকে কীভাবে রাষ্ট্র, সমাজ সংকটাপন্ন করে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেই কাঠামোগত প্রক্রিয়াকে কেউ চিহ্নিত করবে না।’
অপুর মৃত্যু নিয়ে তার শিক্ষক ও ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক ‘অপুকে ধারণ করার যোগ্যতা সিস্টেমের নেই’ শিরোনামে এক আবেগঘন ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘মাসুদ আল মাহাদী (অপু) মেধাবি ছাত্র ছিল, সত্যিকারের মেধাবি। ফলাফল ভালোও করতো। তবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল করাদের মতো সে ক্লাসে খুব নিয়মিত ছিল না। সে প্রশ্ন করতো, প্রতিবাদ করতো। ষাটের দশক কিংবা নিদেনপক্ষে আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেসব শিক্ষার্থী নিয়ে গর্ব করতো, যাদের কারণে ছাত্র আন্দোলন বিষয়টা একটা স্বর্ণালী এক রোমান্টিসিজম এখন, অপু ছিল সে ধরনের শিক্ষার্থী।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি চাইতাম তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকুক, তাকে কিছু পরামর্শ তো দেয়া যেত। কিন্তু খবর দিলেও সে আসতো না, ফেসবুকও ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছে বহুদিন। বলছিলাম সে সিস্টেমের বঞ্চনার শিকার। সাংবাদিকতার যে অবস্থা, সেখানেও নিশ্চয় সে হতাশ হয়েছে। নিরাপদ চাকরির জন্য সে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তা অপুর স্বভাববিরোধী। তার স্বভাব ধারণ করার একমাত্র জায়গা হতে পারতো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানে ঢোকার সুযোগ তার নেই।’
অপুর মৃত্যুর নিয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশের লালবাগ জোনের উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দিন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটি আটতলা। এর তিনতলা পর্যন্ত বিভিন্ন অফিস। পাঁচতলা থেকে বাকি তলাগুলোতে ২৫০ জনের মতো বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মেস করে থাকেন। যিনি মারা গেছেন, তাঁর কক্ষে তিনিসহ মোট তিনজন থাকতেন। অন্য দুজন কোনো একটি বেসরকারি চাকরি করেন, পাশাপাশি সরকারি বড় চাকরির চেষ্টা করছেন। সকালে তাঁরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। মাসুদ আল মাহাদী এখানে এসেছেন তিন মাস আগে। দুপুর ১২টার দিকে সর্বশেষ পাশের কক্ষের একজনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। দুইটার দিকে অন্য দুই রুমমেট ফিরে এলে দেখতে পান, কক্ষের ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মেসমেটদের বক্তব্য অনুযায়ী পরে তাঁরা অন্যদের ডাকেন। অন্যরা আসার পর দরজা ভেঙে তাঁরা ওই কক্ষে ঢোকেন। তাঁদের কাছে যখন মনে হয়, মাসুদ আল মাহাদী আর বেঁচে নেই, তখন তাঁরা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন। বেলা ২টা ১০ মিনিটের দিকে আমরা খবর পেয়ে এখানে আসি। এখন সুরতহাল চলছে, পরে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গেও পাঠানো হবে। এরপর পরিষ্কার হবে যে তিনি ঠিক কীভাবে মারা গেছেন। তার ওপর ভিত্তি করে এবং আনুষঙ্গিক-পারিপার্শ্বিক সবকিছু দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’