১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৫৬

চবি প্রশাসনকে পাল্টা শোকজ ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নেটওয়ার্ক’র

চবি প্রশাসনকে পাল্টা শোকজ  © টিডিসি ফটো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) তিন শিক্ষার্থীকে শোকজের প্রতিবাদে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নেটওয়ার্ক’র পক্ষ থেকে চবি প্রশাসনকে পাল্টা শোকজ করা হয়েছে। শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) দেশের ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ জন ছাত্র প্রতিনিধির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি কারণ দর্শানো নোটিশ চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।

এই প্রথম কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সারাদেশেরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীদের প্লাটফর্ম থেকে প্রতিবাদস্বরূপ শোকজপত্র প্রেরণের ঘটনা ঘটেছে।

শোকজের একটি অনুলিপিটি চবি আচার্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ, ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহিদুল্লাহ ও চবি প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া বরাবরও প্রেরণ করা হয়েছে।

শোকজপত্রে বলা হয়েছে, ‘আমরা সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্লাটফর্ম ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নেটওয়ার্ক ’ এর পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত কতিপয় সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করা, তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জোরপূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের মধ্য দিয়ে কতিপয় গুরুতর অপরাধ সংগঠিত করা হয়েছে।’

চবি প্রশাসনের এহেন কর্মকাণ্ড নজীরবিহীন এবং চরম ন্বেচ্ছাচারীতার বহিঃপ্রকাশ উল্লেখ করে আরও বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের আবাসন ও পরিবহন নিশ্চিত করে পরীক্ষা গ্রহণ করা বিশ্ববিদ্যারয়ের দায়িত্ব। তা না করে উপরন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বন্ডসই আদায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি ও স্বাধীন অভিব্যাক্তি প্রকাশের অধিকারকে রুদ্ধ করা হয়েছে। যা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে একজন শিক্ষার্থীর সভা সমাবেশ ও স্বাধীন মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারকে হরণ করে। ফলে প্রশাসনের এরূপ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত মাত্রায় অগণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অবৈধ তৎপরতা বলে আমরা মনে করি।’

চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মুচলেকা নিয়ে তিন ছাত্রকে শোকজ করাকে ফৌজদারী অপরাধ আখ্যা দিয়ে আরও বলা হয়েছে, ‘গত ৭ সেপ্টেম্বর সংবাদ মাধ্যম ‘চট্টগ্রাম প্রতিদিন’ এ দেয়া এক বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জনাব রবিউল হাসান ভূঁইয়া দাবি করেন , মিটন চাকমা নামক এক শিক্ষার্থী পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে লিখিত দিয়েছে সে পরিবহন ও আবাসিক হল খোলার দাবি করবে না তারপরও সে কেন আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে ? আমরা মনে করি একটি অবৈধ মুচলেকার উপর ভিত্তি করে কোন শিক্ষার্থী কোন নৈতিক আন্দালনে যুক্ত হবে কিংবা হবে না সেই প্রশ্ন তোলাই প্রক্টর মহোদয়ের এখতিয়ার বর্হিভূত কাজ। বরং এরকম জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে মিটন চাকমা উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং স্পষ্টতই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্ররোচনায় ৩ ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপনে বাধ্য হয়েছে।’

সেই তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগকে অন্তঃসারশূন্য উল্লেখ করে আরও বলা হয়েছে, ‘মিটন চাকমার কাছ থেকে মিথ্যা অভিযোগপত্র আদায় করে তার ভিত্তিতে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী রাজেশ্বর দাশ গুপ্ত , ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শাহ মোহাম্মদ শিহাব ও ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আশরাফি নিতুকে শোকজ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে- ‘অভিযোগকারী শিক্ষার্থীকে আন্দোলন কর্মসূচিতে আসতে প্ররোচিত করেছে।’ এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ১০৭ ধারা অনুসারে কোন অপরাধ সংগঠনে সহায়তা করাকে প্ররোচনা বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোন দাবিতে মিছিল, মানববন্ধন কিংবা প্রতিবাদ কর্মসূচি করা কোন অপরাধমূলক কাজ নয়। এখানে শিক্ষার্থীরা নিজের অধিকার আদায়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য কোন শিক্ষার্থীকে প্ররোচিত ও বাধ্য করার অভিযোগ একটি অন্তঃসারশূণ্য অভিযোগ।’

‘আবার অভিযোগকারী মিটন চাকমা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আহবায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার সাংগঠনের পক্ষ থেকে পরিবহনের দাবির পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেছেন। ফলে তাকে ব্যক্তিগত প্ররোচনার অভিাযোগ ভিত্তিহীন। আবার যেকোন ন্যায্য দাবি প্রচারের অধিকার শিক্ষার্থীদের আছে। একে প্ররোচনা কিংবা বাধ্য করা হিসাবে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে কার্যত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন শিক্ষার্থীর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করছে।’

শোকজপত্রে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সকল কার্যক্রমকে কেন রাষ্ট্রের আইন ও সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও ইস্যুকৃত শোকজ নোটিশ কেন প্রত্যাহার করা হবে না- এই মর্মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জবাব দেয়ার জন্য বলা হলো।’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নেটওয়ার্ক এর পক্ষ থেকে ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি এই শোকজপত্রে স্বাক্ষর করেন।

ছাত্র প্রতিনিধিরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আদনান আজিজ চৌধুরী, আরাফাত সাদ, রবিউল ইসলাম মিম, মোকতার আহমদ, মিশকাত মহিউদ্দিন, সায়েদুল হক নিশান, সাদিক মাহবুব ইসলাম ও জাবির আহমেদ জুবেল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন তুষার ধর, রাকিবুল হক রনি, তাসবিবুল গনি নিলয়, শোভন রহমান, হাসান জামিল, ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলি, ফারুক ইমতিয়াজ, আবু সাইদ, সুদীপ্ত দে ও অমর্ত্য রায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন সব্যসাচী জহির, ইমন সৈয়দ ও আজাদ হোসেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন আজিজুল হক মানিক, মহাব্বত হোসেন মিলন ও মিঠুন চন্দ্র মোহন্ত। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন মোস্তাক আহমেদ, আশিক বিশ্বাস ও ইমামুল ইসলাম সোহান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন শাহ সাকিব সোবহান। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষার করেছেন সামিউল এহসান শাফিন, মারুফ-উল-আলম, সংঘ মিত্রা, সামিরা ফারজানা ও কাজল দাস।

শোকজপত্রে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন আলিসা মুনতাজ, শুভদ্বীপ অধিকারী, সুজয় শুভ ও জামান কবির। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন জি. কে. সাদিক, অনি আতিকুর রহমান ও আব্দুর রউফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন ইশতিয়াক আহমেদ রিফাত, কাফি মোহাম্মদ তামিম ও রাজিত ইয়ামিন হাসান। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন তানজিলা ইসলাম ঋতু, উত্তম কুমার বালা, অপুরান্ত মন্ডল ও তনুশ্রী চৌধুরী।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন তাহমিদ হোসেন, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন স.ম. নাহিন রহমান। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন আসিফ ইকবাল ও শাফায়েত জামিল। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন অরূন্ধতী রায়। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন তামজিদ মুশফিক। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন রিয়াদ রাসেল। বাংলাদেশে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন তাসনুভা বিনতে মমিন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাক্ষর করেছেন সুজয় সরকার, মিজান মাহিন ও তানজিনা বেগম।

এছাড়াও শোকজপত্রে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্বাক্ষর করেছেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাক্ষর করেছেন তাসনীম মাজহার ও রাজিত। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে স্বাক্ষর করেছেন সৈয়দ ইনজাম উল হুদা, মোঃ শোয়ায়েব হোসেন ও ইয়ামিন হাসান। প্রাইমেশিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাক্ষর করেছেন আবদুল্লাহ্ মেহেদী দীপ্ত। বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ থেকে স্বাক্ষর করেছেন সাইফুর রুদ্র। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাক্ষর করেছেন সুবর্ণা আক্তার রিয়া। এআইইউবি থেকে স্বাক্ষর করেছেন জুবায়ের হাসান।

আইইউবিএটি থেকে স্বাক্ষর করেছেন তানজিদ সোহরাব। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল থেকে স্বাক্ষর করেছেন আবু সাইদ অনয়, তাহমিদ ফায়াজ মাহির, মোহাম্মদ সাজিদ হোসেন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাক্ষর করেছেন পিয়াল বিশ্বাস। নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি স্বাক্ষর করেছেন মো. আল আমিন শেখ। ট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাক্ষর করেছেন মনীষা ওয়াহিদ। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাক্ষর করেছেন ফাহিম আহমেদ চৌধুরী।

উল্লেখ্য করোনার অজুহাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা নেয়ার শর্ত হিসাবে , আবাসিক হলে না থাকা এবং যাতায়াত ব্যবস্থার দাবি তোলা যাবে না এই মর্মে নির্দিষ্ট ফরমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করা হয়েছে। কয়েকটি বিভাগে শিক্ষার্থীদের এই শর্ত সমেত গুগল ফর্মও পূরণ করানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর মিটন চাকমা নামের এক ছাত্রকে জোর করে পদযাত্রায় যেতে বাধ্য করার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) তিন শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়ে তিন দিনের মধ্যে প্রক্টরের দফতরে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে লিখিত জবাব দিতে হবে।

অভিযুক্ত তিনজন হলেন— ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফী নিতু, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের বিশ্ববিদ্যালয় নেতা অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শাহ মোহাম্মদ শিহাব ও সংগঠনটির চট্টগ্রাম নগরের নেতা ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রাজেশ্বর দাশগুপ্ত।

‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নেটওয়ার্ক’ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্বিলিত একটি সংগঠন। যা একই নামে একটি ফেইসবুক গ্রুপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।