মানসিক অবসন্নতায় ভুগছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
পারিবারিক, সামাজিক চাপ ও অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় মানসিক অবসাদ আর অবসন্নতায় ভুগছে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সম্ভাব্য সেশনজট, পরীক্ষাগ্রহণে জটিলতা, ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতাসহ অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রমে নানাবিধ অনিশ্চয়তার ফলে দিনকেদিন শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তার রাজ্য আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাড়ছে অবসাদ, অবসন্নতা এবং দুশ্চিন্তা। ঘটছে হরহামেশা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও।
তবে দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে নিয়মিত সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। যদিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কিছুকিছু কলেজের শিক্ষার্থীদের অনলাইন পাঠদানে ইউটিউব বা ফেসবুকে শিক্ষকদের রেকর্ডেড ক্লাস আপলোড করা হয়েছে, তবুও সরাসরি ক্লাস করে অভ্যস্ত শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন শিক্ষকদের সাহচর্য না পাওয়ায় পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
অপরদিকে আবার হল ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে অবস্থান করায় পারিবারিক নানা চাপেও কাবু শিক্ষার্থীরা। পরিবারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের অনেকেই পাচ্ছেন না পূর্ণ সহযোগিতা। এক্ষেত্রে বেশি বিপাকে পড়েছে খন্ডকালীন চাকুরি বা টিউশনির মাধ্যমে জীবননির্বাহ করা শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর পুরান ঢাকা, চাঁনখারপুল, আজিমপুর, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, সাইন্স ল্যাবরেটরি, গ্রীন রোড, জিগাতলা, ধানমন্ডি, কলাবাগানসহ আশেপাশের আবাসিক এলাকার অসংখ্য স্কুল, কলেজ পড়ুয়া শিশুকিশোরদের টিউশনি করিয়ে ও বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে নিজেদের পড়াশোনা ও হাতখরচের ব্যায় নির্বাহ করতো এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা অগনিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স সহ আশেপাশের অসংখ্য সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এসব এলাকায় টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ নির্বাহ করতেন। যার অধিকাংশই লকডাউন ও দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এছাড়াও অসংখ্য শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা ক্লাস এর পর বিভিন্ন সুপারশপ, দোকান, শোরুমে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। করোনার দীর্ঘ ছুটিতে এসব চাকরিও হারাতে হয়েছে তাদের।
বিপাকে বেশি পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। করোনায় লকডাউনের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের আয় কমে গেলেও কমেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফিসহ অন্যান্য চার্জ। তাই এসবের যোগান দিতে প্রতি মুহূর্তেই দুশ্চিন্তায় সময় পার করতে হচ্ছে তাদের। এমন অবস্থায় পড়াশোনা, অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা ও অনাগত ভবিষ্যৎতের কথা চিন্তা করে হতাশার মধ্যে রয়েছে তারাও।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, সেমিস্টার যেতেই নির্দিষ্ট পরিমান টাকা পরিশোধ করা লাগছে। প্রাথমিক অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে থেকেই অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করলেও ইন্টারনেট স্বল্পতা এবং ইন্টারনেটের পেছনে অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসে থাকতে হচ্ছে। ঢাকায় মেস খরচ এবং নিজের থাকা খাওয়ায় সব মিলিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা যোগাড় করতে হচ্ছে। অপরদিকে কোন টিউশনি এবং খণ্ডকালীন চাকরিও খুঁজে পাচ্ছি না। যার ফলে মানসিকভাবে খুব দুশ্চিন্তায় মধ্যে থাকতে হচ্ছে।
সদ্য পড়ালেখার পাঠ যারা চুকিয়েছেন তারাও খুঁজে পাচ্ছেন না কোন চাকরি-বাকরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা নাজমুল হাসান বলেন, করোনার আগ মুহূর্তে আমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এরপর থেকে করোনা সংক্রমণের ফলে অধিকাংশ নিয়োগ পরীক্ষায় বন্ধ রয়েছে। যার ফলে স্থায়ী কোনো চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঢুকে যাব নাকি সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করবো বুঝতে পারছিনা।
এমন অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের পাশে প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের শিক্ষকদের দাঁড়ানো উচিত। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর রাখার মাধ্যমে তাদের হতাশা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যা দূরীকরণে শিক্ষকরা অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। পাশাপাশি এই অবস্থায় পরিবারকেও শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সুন্দর আচরণের মাধ্যমে মনে সাহস যোগানোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করছেন তাঁরা।
ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আখতারা বানু বলেন, আমাদের দেশে সচেতনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেইনা। অধিকাংশই শুধু শারিরিক অসুস্থতা নিয়ে চিন্তা করি। তাছাড়া মনোজগতে কত রকমের সমস্যা তৈরি হতে পারে সে ব্যাপারে অবিভাবকদেরও তেমন কোন চিন্তা নেই৷ মানসিক সমস্যার শিকড় থাকে অনেক গভীরে৷ এই সমস্যা যদি তরুণতরুণীদের মনে দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে এক পর্যায়ে আত্মহত্যার শঙ্কাও থাকে।
তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছালে দ্রুতই হয়তো প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর মাঝে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই শিক্ষার্থীরা নানা দুশ্চিন্তায় মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছে। এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহস সঞ্চার করে তাদেরকে বুঝাতে হবে যে খারাপ পরিস্থিতি শেষ হয়েছে, খুব দ্রুতই ভালো পরিস্থিতি আসছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি করোনাকালীন সময়ে আত্মহত্যার সংখ্যাও বেড়েছে। এটি মূলত একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, মানসিক দুশ্চিন্তা, অবসাদগ্রস্ততা থেকে হয়। তাই পরিবারের উচিত বাড়িতে যে সকল শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের সাথে সমন্বিত সময় কাটানো, সকল কিছু নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা ও সমস্যার সমাধান করা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক শিক্ষকরা মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সিলর হিসেবে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নে কাউন্সিলিং করতে পারেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রাখার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় করুণা পরবর্তী সময় নিয়ে সরকারের সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা জানালেও শিক্ষার্থীরা অনেকটা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন বলেও মনে করেন তিনি।