এবারও নেই ঈদ আনন্দ, আছে ভয়
আজ মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কার মধ্যেই গতবারের মতো এবারও ঈদ উদযাপন করবেন মুসলমানরা। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈদকে ঘিরে যে আনন্দ-উচ্ছাস থাকার কথা তা ম্লান করে দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস।
করোনা মোকাবিলায় ও সংক্রমণ বিস্তার রোধকল্পে ঈদুল ফিতরের মতো এই ঈদেও সরকারের নির্দেশনায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঈদের জামাত শেষে কোলাকোলি এবং হাত মেলানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মহামারীর এই করুণ সময়ে এবারের ঈদ ব্যক্তিজীবনে কতোটা আনন্দময় হবে তা নিয়ে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। জানাচ্ছেন জাবি প্রতিনিধি মেহেদি মামুন-
এবারের ঈদ উদযাপনের বিষয়ে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিহা আফনান শাহেদ বলেন, ঈদ মানেই ত্যাগের উৎসব। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম কুরবানির ঈদে কমবেশি সবাই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কুরবানি দিত। পাড়া প্রতিবেশী মিলে একসাথে আনন্দ করা, গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করা, সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন থেকে শুরু করে সব হতো ঈদে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বাড়ি যাওয়াতেও ক্লান্ত ভাব থাকতো না কারও ভিতর। কিন্তু গতবারের মত এবারও নেই ঈদ আনন্দ, না আছে অগনিত মানুষের কুরবানি দেওয়ার সামর্থ্য, না আছে মানুষের বাড়ি যাওয়ার বাহন বা সুযোগ।
“এতো কিছু হওয়ার পরও থেমে নেই দিন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের আনন্দ সবার সাথে ভাগ করে নেবো। ঘরে বসে নিজ নিজ জায়গায় থেকে সবাই অনেক আনন্দ করব। যার যার পরিবারের সংকটময় দিন যাচ্ছে দোয়া করি তারা যেন দ্রুত সংকট থেকে পরিত্রাণ পায়। করোনামুক্ত দিন আসুক খুব তাড়াতাড়ি এটাই প্রত্যাশা।”
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাসনুভা মৌমি বলেন, বাবা-চাচা-ফুপু মিলিয়ে আমার দাদুবাড়ির সদস্যসংখ্যা অনেক, তবে কাজের সুবাদে সবাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো। দাদার হুকুম ছিলো, তোমরা যে যেখানে থাকো না কেন, কুরবানী ঈদে সবাইকে বাড়ি আসতে হবে। সকলের নাড়ীর টানে বাড়ি ফেরা তখন দেখেছি। মাইলের পর মাইল গাড়ি দাঁড়ানো, জ্যামের কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে এক জায়গাতেই। তবুও ক্লান্তির বদলে সবার চোখে মুখে চাপা আনন্দ।
“পাঁচ ঘন্টার পথ বার ঘন্টায় পাড়ি দিয়েও ক্লান্ত লাগতো না, বাড়ি গিয়েই খেলতে নামতাম চাচাতো-ফুফাতো ভাই বোনদের বিশাল বাহিনীর সাথে।ঈদের দিন সকালে নতুন জামা পরে বাবা-চাচাদের পিছু পিছু ঈদগাহে যেতাম।পাশেই মেলা হতো, তার লোভেই মূলত। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে শুরু হতো সালামি অভিযান। সারাদিন খাওয়া আর এ বাড়ি ও বাড়ি ঘোরা শেষে রাতে সবাই মিলে গোল হয়ে গোণা হতো, কার সালামি কত উঠলো। ঈদের দু'দিন বাদেই নিজ নিজ বাসায় ফিরতে হতো, আমাদের স্কুল বা বাবাদের কাজের তাড়ায়। তবে ঝুলিভর্তি স্মৃতি নিয়ে ফিরতাম, তা দিয়েই পরের ঈদ পর্যন্ত কাটিয়ে দেয়া যেতো বেশ।”
“দাদা মারা যাবার পর সবকিছু কেমন ফিকে হয়ে গেলো। তাগাদা দেয়ার কেউ নেই, আস্তে আস্তে ঈদে বাড়ি ফেরাও কমতে কমতে থেমে গেলো একসময়। বড় হতে হতে গন্ডি কমলো, ঈদকে উৎসব মনে হয় না আর। শহুরে ঈদ অনেক বেশি কৃত্রিম আর এককেন্দ্রিক। পাশেই হয়ত কোনো এক পরিবার আশায় থাকে, কেউ একটু গোশত দিয়ে যাবে, এই একদিন অন্তত কপালে ভালো খাবার জুটবে। লোক দেখানো উদ্দেশ্যে দেয়া কুরবানি আর এই ঈদ এ কারণে সবার জন্য এক হয়ে আসে না। তবুও প্রার্থনা করি, সবাই নিরাপদ থাকুক। কুরবানি দেয়ার আসল আর প্রকৃত উদ্দেশ্যে থাকুক অপরের জন্য ভাবনা।”
বায়োটেকনোলোজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঈদ হলো খুশির, ঈদ আনন্দের। শুধু খুশি আর আনন্দের দিকটি মনে রাখলে আর কোনো ভাবনা মনে কমই নাড়া দেয়। সমাজের প্রতিটি মানুষের আনন্দ প্রকাশের সমান সামর্থ্য থাকে না, হয়তো কারো দু’চারটা বড় গরু একসাথে সামাল দিতে কষ্ট হবে, আবার কারো দু’এক কেজি মাংস সংগ্রহ করতে দশ বাড়ি চাইতে হবে।
“ত্যাগের যে মহিমান্বিত দিকটি, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। সর্বজনীন ভাতৃত্বের যে স্লোগান ভেদাভেদ নির্মূলের, ঈদ থেকে সে শিক্ষাও আমাদের নিতে হবে। ঈদ হোক প্রতিটি মানুষের জন্য সুন্দর।”