১৭ জুলাই ২০২১, ১৩:১৯

দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক নেতা থেকে প্রো-ভিসির দায়িত্বে অধ্যাপক সুলতান

অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম টিপু  © সংগৃহীত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপ-উপাচার্যের পদে যোগদান করেছেন দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক সমাজের আহবায়ক অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম টিপু। আজ শনিবার (১৭ জুলাই) সকাল ১১ টায় শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনে সীমিত পরিসরের এক আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীয় পদে যোগদান করেন তিনি।

এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, অপর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক একেএম মোস্তাফিজুর রহমান আল-আরিফ, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. আবদুস সালামসহ অনুষদ অধিকর্তা, হল প্রাধ্যক্ষ, বিভাগীয় সভাপতি, অফিস প্রধান, বিশিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ উপস্থিত ছিলেন।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ড. জোহার সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নগরীর শহীদের সমাধিস্থলে সম্মান প্রদর্শন করেন নতুন এই উপ-উপাচার্য অধ্যাপক টিপু।

এসময় অধ্যাপক সুলতান-উল ইসলাম টিপু বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ও শিক্ষামন্ত্রনালয়ের নির্দেশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পদে যোগদান করেছি। তারা আমাকে যোগ্য মনে করেছেন সুতরাং আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে যথাযথভাবে এ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব। এছাড়া পূর্বে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছি, এখন সেভাবেই থাকব বলে জানান এই দুর্নীতি বিরোধী শিক্ষক সমাজের আহবায়ক ও নতুন উপ-উপাচার্য।

এর আগে গত ১৩ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নূর-ই আলম স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে তার নিয়োগের বিষয়টি জানানো হয়।

কে এই অধ্যাপক টিপু?

গত ৩ বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের আলোচিত নাম অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম টিপু। তৎকালীন রাবির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে রাজপথ সরব রেখেছিলেন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক। সাবেক উপাচার্যের নির্যাতন, জুলুম ও রক্তচক্ষু এবং তার সমর্থকদের হুমকি ও অপপ্রচার উপেক্ষা করে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চালিয়ে যান আন্দোলন-সংগ্রাম।

১৯৬১ সালের ৪ মার্চ অধ্যাপক টিপু নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহিম আলী সরকার। যিনি নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে ফিল্ড সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অধ্যাপক টিপুর বড় ভাই অধ্যাপক ড. সোলায়মান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও প্রখ্যাত লালন গবেষক।

১৯৮১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ থেকে সম্মানসহ স্নাতক ও ১৯৮২ সালে স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণীতে প্রথম) পাস করেন অধ্যাপক টিপু। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। সেই সাথে ২০০২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন তিনি।

১৯৯৭ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর ২০০২ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০০৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান।কর্মক্ষেত্রে অধ্যাপক টিপু বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন।

২০১৫-১৮ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনিস্টিউটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক টিপু। ২০১০ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের পক্ষে রাবি শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ এবং ২০১২ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন অধ্যাপক টিপু।

২০১৩-১৬ সাল পর্যন্ত তিনি রাবির নির্বাচিত সিনেট সদস্য এবং ২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন। এসবের পাশাপাশি তিনি রাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু সমাজ-সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা। রাবির বরেন্দ্র জাদুঘর, বুদ্ধিজীবী চত্বর, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এই অধ্যাপক। এছাড়াও ২০১৯ সাল থেকে তিনি নিজ বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের শুরু থেকেই অধ্যাপক টিপু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসাবে কাজ করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের এই শিক্ষক নেতা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে ১৯৮৬-৯৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও উপ পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ বিশেষ করে কয়লা, চিনামাটি, কাচবালি, নুড়ি পাথর ও কঠিন শিলার অনুসন্ধানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি। সেই সময় তিনি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া ও রংপুরের খালাসপীর কয়লাখনির আবিস্কারকদের অন্যতম এবং মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি উন্নয়নে সক্রিয় পরামর্শক ভূতত্ত্ববিদ হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়াও বঙ্গোপসারে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে জার্মান ভূতাত্ত্বিক জরীপ দলের সাথে কাজ করেছেন তিনি।

এছাড়া অধ্যাপক টিপু রাবি এলামনাই এসোসিয়েশন, রাজশাহী কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানজীবি সমিতি, ভারতের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এসোসিয়েশন, নেপাল ও ব্রাজিলের পরিবেশ ও ভূতত্ত্ব সম্পর্কিত সংগঠনের আজীবন ও সাধারণ সদস্য।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে তার ৯২টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ভূতাত্ত্বিক ও পরিবেশ বিষয়ক ৪টি গবেষণামূলক পুস্তক এবং ২টি প্রবন্ধ প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

অধ্যাপক টিপুর শশুর জয়নাল আবেদীন একজন ভাষা সৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। এছাড়াও অধ্যাপক টিপুর মেজো ভগ্নিপতি মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আক্কাছ আলী মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেআইনীভাবে গ্রেফতারকৃত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলন এবং রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্তি আন্দোলন ও আইনী লড়াইয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এই অধ্যাপক। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় তথা জাতীয় পর্যায়ের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সব সময় সক্রিয় ছিলেন অধ্যাপক টিপু।