৯১৭ প্রজাতির বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদের সমারহে অনন্য জাবি ক্যাম্পাস
বৈচিত্রপূর্ণ উদ্ভিদ প্রজাতির সমাহারে অনন্য উদ্যানে পরিণত হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস। পরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদের বৈচিত্র্যময় প্রজাতি জাবি ক্যাম্পাসকে অনিন্দ্য সুন্দর করে তুলেছে। এটি এখন দেশের অনেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তুলনায় সমৃদ্ধ।
রাজধানীর অদূরে অবস্থিত এ ক্যাম্পাসে ১৪৫ গোত্রের ৫৭৪টি পরিবারের ৯১৭ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে ৭০.৩৪ শতাংশ বনজ, ৬৩.৭৯ শতাংশ দেশীয় এবং ৩৬.২১ শতাংশ বিদেশী প্রজাতির।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম কর্তৃক প্রকাশিত দেশের ১৫ প্রজাতির বিপদাপন্ন উদ্ভিদ জাবি ক্যাম্পাসে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। যা উদ্ভিদকুল গঠনের দিক থেকে সাতছড়ি, লাওয়াছড়া ও কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের চেয়ে প্রসিদ্ধ।
২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত জাবি ক্যাম্পাসের উদ্ভিদকুল গঠন সম্পর্কিত একটি গবেষণার ফল বিশ্লেষণে এমন তথ্য জানা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশবিদ্যালয় উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের একটি গবেষকদল এ কার্যক্রম সম্পন্ন করেন।
গবেষকদলে কাজ করেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছালেহ আহাম্মদ খান, অধ্যাপক গাজী মোশারফ হোসেন, সহকারি অধ্যাপক শায়লা শারমিন সেতু, প্রয়াত শিক্ষার্থী ও গবেষক শারমিন সুলতানা এবং টেকনিক্যাল অফিসার আব্দুর রহিম।
গত ২৬শে জুন ‘বাংলাদেশের একটি অর্ধ-প্রাকৃতিক এলাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশবিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উদ্ভিদকুলের গঠন’ (Floristic composition of Jahangirnagar University Campus- A semi-natural area of Bangladesh) শীর্ষক গবেষণাটি বাংলাদেশ জার্নাল অব প্লান্ট ট্যাক্সোনমি’তে প্রকাশিত হয়। জার্নালটি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক সম্পাদিত হয়।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ২২ প্রজাতির টেরিডোফাইট, ১২ প্রজাতির জিমনোস্পার্ম, ৮৮৩ প্রজাতির সপুষ্পক, ২৬৫ প্রজাতির একবীজপত্রী ও ৬১৮ প্রজাতির দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ রয়েছে। যার মধ্যে ২৩ শতাংশ বৃক্ষ, ৫৬ শতাংশ গুল্ম, ১৫ শতাংশ বিরুৎ, ২ শতাংশ আরোহী এবং ১ শতাংশ বাঁশ প্রজাতির।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, জাবি ক্যাম্পাসের সকল উদ্ভিদ পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে ৫৩.৭৬ শতাংশ উদ্ভিদ ঔষধি, ৩৪.৬৮ শতাংশ শোভাবর্ধনকারী, ৯.০৫ শতাংশ চারণ ও ঘাসজাতীয়, ৬.৭৬ শতাংশ ফলজ, ৬.৬৫ শতাংশ শাক-সবজি, ৫.০২ শতাংশ কাষ্ঠপ্রদায়ী এবং ৩.৪৯ শতাংশ জ্বালানী প্রজাতির।
গবেষণার বিষয়ে অধ্যাপক ছালেহ আহাম্মদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো বিশাল আয়াতনে ঘেরা। জাহাঙ্গীরনগর তার মধ্যে অন্যতম। তবে আয়াতনে এর চেয়ে বড় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। বাংলাদেশের ক্যাম্পাস ভিত্তিক উদ্ভিদ বৈচিত্র্য নিয়ে এ ধরণের গবেষণা পূর্বে হয়নি। আমাদের টিম একযুগ ধরে গবেষণাটির পেছনে নিরলসভাবে কাজ করেছে। আমরা ২০২০ সালের জুন মাসে গবেষণাপত্র সাবমিট করি। অবশেষে ব্যাপক পর্যালোচনার পর ২০২১ সালের জুন মাসে এটি প্রকাশিত হয়।’
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের অধীনস্থ বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম কর্তৃক প্রকাশিত হয় রেড ডাটা বুক অব ভাসকুলার প্ল্যান্টস অব বাংলাদেশ। এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিপদাপন্ন ১৫ প্রজাতির মধ্যে ১৪টির প্রাকৃতিক আবাসন জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে রয়েছে।
গবেষণাপত্রে উল্লেখিত ১৪ প্রজাতির তালিকায় তালিপাম, বন খেজুড়, ভূঁইডালিম, কালমেঘ, আগর, জালিবেত, সাচিঁবেত, করাকবেত, কদমবেত, মণিরাজ, তোসাবাক, স্বর্পগন্ধা অন্যতম। এছাড়া দুর্লভ প্রজাতির মধ্যে আছে বুদ্ধ-নারিকেল, ধারমারা, ইদাল, সিভিট, ধুপ, খয়ের, বিভিন্ন ধরণের অর্কিড, বাঁশ ও মসলা। এসব উদ্ভিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিয়ন্ত্রিত বোটানিক্যাল গার্ডেন ও প্ল্যান্ট কনজারভেটরীতে সংরক্ষিত রয়েছে।
গবেষণা সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পাসে ঔষধি উদ্ভিদের মধ্যে বাসক, কালমেঘ, শতমূলী, পুনর্ণভা, থানকুনি, ধুতুরা, কুরচী, তুলসী, অর্জুন, হরিতকি, বহেরা, নিশিন্দা, চন্দন, কপূর উল্লেখযোগ্য।
শোভাবর্ধনকারী হিসেবে গোলাপ, জারুল, বনসোনালু, বার্মিজ সোনালু, রাধাচূড়া, নাগেশ্বর, কাঠগোলাপ, নাগলিঙ্গম, অশোক, মাধবীলতা, নীলমনিলতা, বাসরলতা, রসুনলতা, পারুল, গন্ধরাজ, ক্যমিলিয়া, বাগানবিলাস, দোলনচাঁপা, কামিনী, ঘন্টাফুল, টেকোমা, স্থলপদ্ম, রুদ্রপলাশ সহ বিভিন্ন ধরনের অর্কিড ও পাম উদ্ভিদ অন্যতম।
কাষ্ঠপ্রদানকারী উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে শাল, সেগুন, গর্জন, গামারী, কাঠাল, রেইনট্রি, তেলসুর, মেহগিনি, কড়ই, চাপালিশ, দেবদারু, ছাতিম ইত্যাদি।
ফলদ উদ্ভিদ সমূহের মধ্যে আছে আম, কাঠাল, জাম, লিচু, আতা, শরিফা, আমড়া, কুল, বেল, চালতা, করমচা, বিলিম্বি, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, এভোক্যাডো, ডুরিয়ান, ব্রেড ফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট ও বিভিন্ন ধরনের লেবু।
ক্যাম্পাসে জলজ উদ্ভিদের মধ্যে আছে লাল শাপলা, নীল শাপলা, সাদা শাপলা, পদ্ম, কলমি, আমরুল, পানিকলা, পানিমরিচ, পানিফল, পাতাঝাঁঝি, চাঁদমালা ও পানিসিংগারা, হেলেঞ্চা, ঢোলকলমি, বড়নুখা, কেরালি, শিতলপাটি, ক্ষুদপোনা, টোপাপানা সহ বিভিন্ন ধরনের পানা অন্যতম।
অধ্যাপক গাজী মশারফ হোসেন বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একটি অর্ধ-প্রাকৃতিক নয়নভিরাম নৈসর্গিক এলাকা। আমাদের গবেষণাটি মূলত উদ্ভিদের শ্রেণীতাত্ত্বিক ধারণা, অবস্থান ও ব্যবহার কেন্দ্রীক।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণার ফল বিশ্লেষণে আমরা আশ্চর্য হয় যে, ক্যাম্পাসে উদ্ভিদের বৈচিত্র্যপূর্ণতা দেশের অনেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলকেও হার মানিয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছিলো এ ক্যাম্পাসে পরিকল্পিত বনায়নের কারণে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ অংশীজনদের দায়িত্ব উদ্ভিদের বিচিত্র এ সম্ভারকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা। যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জাহাঙ্গীরনগর তাঁর সবুজ বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়।’
টেকনিক্যাল অফিসার আব্দুর রহিম বলেন, 'প্রকাশনাটি ক্যাম্পাসের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যসংক্রান্ত তাত্ত্বিক ধারণাকে বাস্তবিকরূপ দিয়েছে। এটি তুলে ধরার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় বিরল ঐতিহ্য ও মর্যাদার আসন দখল করেছে -এ গর্ব আমাদের সকলের। এর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।'
গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়, ‘মানুষের কিছু কর্মকান্ড যেমন- বনে আগুন লাগানো, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, গবাদি-পশুচারণ, জ্বালানীকাঠ ও পাতা সংগ্রহকারী এমনকি অযাচিত দর্শনার্থী অনুপ্রবেশের কারনে ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। এছাড়া কতিপয় বিদেশী আগ্রাসী উদ্ভিদ আকাশমনি, আসামলতা ও কচুরিপানা বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদ যেমন- ছন, কুটুসকাটা, পারথেনিয়াম, লজ্জাবতী প্রভৃতির বৃদ্ধিকে রহিত করছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরী।
সহকারি অধ্যাপক শায়লা শারমিন সেতু বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন, প্ল্যান্ট কনজারভেটরী ও ছোট ছোট বাগান রয়েছে যা উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্যে অপ্রতুল। এবস্থায় পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং এর বিকাশ ঘটাতে হবে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক অবদানের পাশাপাশি টেকসই আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত পরিষেবায়ও গুরুত্বর্পূণ অবদান রাখার সুযোগ রয়ছে।’
তিনি বলেন, ‘সকলের সচেতনতা, পরিকল্পিত ও উপযুক্ত প্রজাতির প্ল্যান্টশেন, উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় সংরক্ষন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। তবেই এলাকাটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভিদ সংরক্ষণের একটি ব্যতিক্রমধর্মী নিবিড় সূতিকাগার হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।’
এদিকে ২০১৯ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলমান রয়েছে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প। যার অধীনে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নির্মিত হবে ২২টি ভবন। উন্নয়ন প্রকল্প উদ্ভিদের নিরাপদ আবাসের ওপর কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষকদল বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। উন্নয়ন প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে এটি উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্যের ওপর নিয়ামক আচারণ করবেনা।