মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ঢাবি ক্যাম্পাস যেমন ছিল
ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নির্মাণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূমিকা সর্বজনবিদিত। কিন্তু ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে যে মুক্তিযুদ্ধের শুরু, সে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কী কী ঘটেছিল, তার অনেক বিবরণ সকলের জানা নেই।
অপারেশন সার্চলাইট
২৫শে মার্চ রাতে যে ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালানো হয়েছিল দেশজুড়ে, যে রাতটিকে 'কালরাত্রি' বলে বর্ণনা করা হয়, সেই হামলার বিবরণ সম্পর্কে ওই সময় ঢাকায় দায়িত্বরত পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতিকথা থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিদ্দিক সালিক। 'উইটনেস টু সারেন্ডার' শিরোনামের একটি বইয়ে তিনি 'অপারেশন সার্চলাইট' নিয়ে লিখেছেন, 'পরিকল্পনা করা হয়েছিল, ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বালুচ ও ৩২ পাঞ্জাবের সমন্বয়ে গঠিত একটি মিশ্রিত দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে ধাবিত হবে'।
'বিশেষ করে ইকবাল হল (এখনকার সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলের দিকে এগিয়ে যাবে।'
হামলায় ব্যবহৃত হয়েছিল স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ট্যাংক বিধ্বংসী রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লঞ্চার, মর্টার, ভারি ও হালকা মেশিনগান।
গোলাগুলি এবং অগ্নিকাণ্ডের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আগুনের লেলিহান শিখা এখনকার সংসদ ভবনের সামনের চত্বরে বসানো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে দেখা যাচ্ছিল।
সিদ্দিক সালিক বর্ণনা করেছেন, 'মধ্যরাতে ধুম্রকুন্ডলী এবং অগ্নিশিখা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাড়িয়ে আকাশে মাথা তুললো।'
তার বয়ানে 'উইটনেস টু সারেন্ডার' বইয়ে তিনি লিখেছেন, "...প্রায় রাত দু'টার দিকে জিপের ওপর বসানো বেতার যন্ত্রে বার্তা এসেছিল, যন্ত্রের অপর প্রান্ত থেকে একজন ক্যাপ্টেন জানান, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে তাকে প্রচণ্ড রকমের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।"
"সে মুহূর্তে একজন সিনিয়র অফিসার বেতার যন্ত্রের মাউথপিসটা মুখের সামনে এনে চিৎকার করে বলেন, 'লক্ষ্যকে ধ্বংস করতে তোমার আর কতক্ষণ লাগবে?' জবাব আসে 'চার ঘণ্টা।'
সিনিয়র অফিসার জবাবে বলেন, '..ননসেন্স। কী কী অস্ত্র আছে তোমার কাছে? রকেট লঞ্চার, রিকয়েললেস রাইফেলস, মর্টার, সবগুলোই ব্যবহার কর। পুরো এলাকা দুঘণ্টার মধ্যে দখলের ব্যবস্থা কর।"
সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, "ভোর চারটায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে আসে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর'।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ভয়াবহতা সম্পর্কে একটি বর্ণনা সিদ্দিক সালিকের বইয়ে পাওয়া যায়। তিনি ২৬শে মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, পাঁচ থেকে পনের মিটার ব্যাসার্ধের তিনটি গণকবর দেখেছেন তিনি ক্যাম্পাসে।
কিন্তু তার ভাষায়, 'কোন অফিসার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করতে চাইছিল না।'
ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এভাবে, "দূর থেকে মনে হয়েছিল, হামলার সময় দু'টি ভবনই মাটির সাথে মিশে গেছে। বাহ্যত প্রতীয়মান হলো, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে চারটি রকেট আঘাত হেনেছে।
কক্ষগুলো বেশিরভাগই পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়েছে, কিন্তু দেয়াল অক্ষত আছে। কয়েক ডজন অর্ধদগ্ধ রাইফেল ও কিছু ছড়ানো ছিটানো কাগজ তখনো ধিকি ধিকি জ্বলছিল। ক্ষতির পরিমাণ ছিল নিদারুণ।"
শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং কর্মচারীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে মি. সালিক লিখেছেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে সেনাবাহিনীর অফিসারেরা একশ'র কথা বললো। সরকারিভাবে চল্লিশজন নিহত হবার খবর স্বীকার করা হল।'
ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল ছাড়া ওই রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হল, শহীদুল্লাহ হল, নীলক্ষেত ও ফুলার রোডে শিক্ষক কোয়ার্টার, জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারেও হামলা চালানো হয়। সে রাতে রোকেয়া হলেও পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করেছিল।
কিন্তু হলে ছাত্রীদের খুঁজে না পেয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক আখতার ইমামের বাড়ি এবং হাউজ টিউটরদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী।
২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তার কোন পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এ পর্যন্ত ১৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা আছে।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর' বইয়ে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী এবং তাদের পরিবার ও স্বজন মিলে ৩০০ জনের মত মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
কালরাত্রি পরবর্তী ভুতুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর' বইয়ে লিখেছেন, ২৫শে মার্চ রাতে হামলার পর ২৬ তারিখ সারাদিন এবং সারারাত থেমে থেমে বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি এবং গোলাবর্ষণ চলেছে।
মার্চের শুরু থেকে রাজনৈতিক অবস্থার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান শিক্ষার্থীদের বড় অংশটি, অনেক শিক্ষকও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাসভবন ছেড়ে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করেন।
এরপরও শিক্ষকদের মধ্যে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, তাদের একজন নজরুল গবেষক ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিনি তখন নীলক্ষেত এলাকায় ইকবাল হল সংলগ্ন শিক্ষকদের কোয়ার্টারে ২৪নং বাড়িতে থাকতেন, ২৫শে মার্চ রাতে ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
তিনি বলেন, ২৭শে মার্চ সাময়িকভাবে গোলাগুলি যখন থামে, ততক্ষণে ছাত্র-শিক্ষক, আর কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা ছিল তারা হয় নিহত হয়েছে, অথবা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছে। যে কারণে ক্যাম্পাসে নেমে আসে এক ভূতুড়ে পরিবেশ।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রবেশ মুখগুলোতে সশস্ত্র পাহারা বসিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। এছাড়া রোকেয়া হল এবং শহীদ মিনার এলাকাতে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর উদ্যোগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সে সময় জেনেভাতে ছিলেন। সেখানে থাকার সময়ই তিনি ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞের খবর পান, এরপর তিনি পাকিস্তানে কর্তৃপক্ষের কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে জেনেভা থেকে লন্ডনে চলে যান। ফলে ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একরকম অভিভাবক শূন্য।
এদিকে, কিছুদিন পর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাভাবিক রয়েছে সেটি প্রমাণের জন্য দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয়। সেজন্য একটি 'বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্বিন্যাস কমিটি' গঠন করা হয়।
এই কমিটির মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের ২১শে এপ্রিল কাজে যোগ দিতে আদেশ দেয়া হয়। আর বাকি শিক্ষকদের ১লা জুন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আদেশ আসে। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হয়।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে উপাচার্যদের তালিকা তার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, সেখানে ১৯৭২ সালের ২০ শে জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, দোসরা অগাস্টে ক্লাস শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়।
তিনি বলেছেন, "মূলত কলা অনুষদেই কয়েকটি বিভাগে ক্লাস শুরু হয়, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদে বলতে গেলে কেউ ছিল না। ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল খুব কম। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, প্রায় প্রতিদিনই কলাভবনের সামনে বা পেছনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ হচ্ছে।"
"ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, তারা গ্রেনেড ফাটিয়ে ক্লাসে ঢুকে যেত। ফলে, পাকিস্তানি বাহিনী কাউকে ধরতে পারত না।"
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর নজরদারি করত পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহায়তায় গঠন করা বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অভিযোগে নানাভাবে শিক্ষকদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়।
কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নির্যাতন শিবিরে নিয়ে রাখা হয়। চাকরীচ্যুত করা হয়েছিল কয়েকজন শিক্ষককে। এছাড়া দফায় দফায় লিখিতভাবে সতর্ক করা হয় শিক্ষকদের মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন তাদের।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ।
বুদ্ধিজীবী হত্যা
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষদিকে এসে পাকিস্তানি বাহিনী শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং চিকিৎসকসহ নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে নানা রকম বার্তা আদানপ্রদান হচ্ছিল। এর মধ্যে ১৪ই ডিসেম্বর ছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বশেষ দিন।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, মূলত ওই দিনটিতে স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও আল শামসের মত মিলিশিয়া বাহিনীর সাহায্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দিবস থাকলেও বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোন তালিকা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছিলেন গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জিসি দেব), জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, মোহাম্মদ আনোয়ার পাশা, এসএমএ রাশিদুল হাসান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মোহাম্মদ সাদত আলী প্রমুখ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা