প্রতিষ্ঠাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইতেন না মেয়ে শিক্ষার্থীরা
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ অঞ্চলের নারীদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল না। তৎকালীন উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান কলকাতার সাথে দূরত্ব, শিক্ষার অভাব এবং রক্ষণশীলতার বাঁধা পেরিয়ে মুসলমান পরিবারের মেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবে, এমন ভাবনা ভাবত না অধিকাংশ পরিবার। সে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের মানুষের মনে রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ সামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন তৈরি করেছিল। সে সুযোগ তৈরি করেছিল ১৯২০ সালে করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ। কারণ সেখানে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষ সবার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ অবারিত রাখা হয়েছিল।
এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করছে। ১০০ বছর আগে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে, সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৮৪৭ জন, যাদের মধ্যে ছাত্রী ছিলেন মাত্র একজন। বর্তমানে সেই চিত্র পাল্টেছে। নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা আখতার মনে করেন, এ অঞ্চলে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
সানজিদা আক্তার এক প্রতিবেদনে বলেন, কেননা উচ্চশিক্ষা লাভ করে প্রায় প্রতিটি ছাত্রী, বিশেষ করে শুরুর দিককার ছাত্রীরা, সমাজে একেকজন নারীশিক্ষার রোল-মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের দেখে আরো মানুষ উৎসাহিত হয়েছেন, তারা নিজেরাও সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারে কাজ করেছেন।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের এলিট পরিবারের বা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা পড়তে আসতেন। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরা পড়তে আসতেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ বইয়ে লিখেছেন, শুরুতে মুসলিম পরিবারের মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই কম পড়তে আসতেন। শুধু মুসলমান পরিবারই নয়, অনেক হিন্দু শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন না। সে সময় এমনও হয়েছে, সনাতন ধর্মের নারীরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে অনেক সময়ই সঙ্গীর অভাবে অর্থাৎ নারী সহপাঠী না পেয়ে কলকাতায় চলে গেছেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সে পরিস্থিতি একটু একটু করে পরিবর্তন হতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া একমাত্র ছাত্রী ছিলেন লীলা নাগ। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করতে ভর্তি হয়েছিলেন, ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর তিনি নারীশিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
বাংলাদেশের জাতীয় এনসাইক্লোপিডিয়া বাংলাপিডিয়ায় লীলা নাগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “১৯২৩ সালে নারীশিক্ষা প্রসারের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে লীলা নাগ দীপালি সঙ্ঘ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। দীপালি সঙ্ঘের সাহায্য নিয়ে তিনি দীপালি স্কুল নামে একটি স্কুল ও অন্য বারোটি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।”
“তিনি (লীলা) নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষাভবন নামে পরিচিত অন্য দুটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমান নারীদের শিক্ষায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।”
সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ বইয়ে লিখেছেন, “মুসলমান সমাজে পর্দার কড়াকড়ি অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায়, ঘরের বাইরের কাজকর্মে মুসলমান মেয়েদের বিশেষ পাওয়া যেত না।”
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই বাংলার বাঙালি নারীর জীবনের দরজা খুলে দিয়েছিল বলে লিখেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ।
ফজিলতুন নেসা ছিলেন প্রথম মুসলিম ছাত্রী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলতুন নেসা ১৯২৫ সালে গণিত বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন।
১৯২৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করে বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন।
ফজিলতুন নেসা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
ইডেন কলেজে বিজ্ঞান ও বাণিজ্যশিক্ষা বিভাগ খোলা, এবং ইডেন কলেজকে স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত করাসহ নারীর উচ্চশিক্ষা বিষয়ক অনেকগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
১০০ বছরে নারীর অংশগ্রহণ
১৯২১ সালে মাত্র একজন নারী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল যে বিদ্যাপীঠে, ১৯২৭ সালে সেখানে ছাত্রী ছিলেন নয়জন। ছাত্রী সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ১৯৩৪-৩৫ সালে ছাত্রী ছিলেন ৩৯ জন।
এক দশক পরে ১৯৪৫-৪৬ সালে ৯০ জন ছাত্রী ভর্তি হন। ষাটের দশকের প্রায় শেষদিকে, অর্থাৎ ১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১,৩৩৬ জন।
আর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমাবর্তনের সময় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩৯৬ জন।
এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৫ জন। মোট ১৯৯২জন শিক্ষকের মধ্যে এখন নারী শিক্ষকের সংখ্যা ৬৬৮ জন। কিন্তু শুরুতে কলা ও বিজ্ঞান অনুষদ, এবং আইন বিভাগ নিয়ে শুরু হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ছিলেন ৬০ জন। যাদের মধ্যে নারী শিক্ষক ছিলেন না একজনও। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন পদেও সে সময় নারী কর্মী ছিলেন না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীর সংখ্যা ছাত্রের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় এক শতাব্দী আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নেয়া নারীদের বড় অংশটি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।
সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীশিক্ষা বিস্তারে এই নারীদের বড় ভূমিকা রয়েছে।
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আখতার বলেছেন, একটা সময় নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিভাগেই পড়াশোনা করতেন, বেশিরভাগ কলা অনুষদের কয়েকটি বিভাগে পড়তে চাইতেন। কিন্তু ক্রমে সে অবস্থাটিও পরিবর্তন হয়, এবং বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদেও নারীর সংখ্যা বাড়ে। এখন প্রায় সব অনুষদেই নারী শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায় সমানের কাছাকাছি।
নারীর ক্ষমতায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে এসে কেবল পড়াশোনাতেই আটকে থাকেননি নারীরা। তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন। রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে নারী শিক্ষার্থীদের উল্লেখোগ্য অবদান ছিল।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, তিনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
নারীর ক্ষমতায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ তার 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা' বইয়ে লিখেছেন, “মেয়েদের পরবর্তীকালে এই যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আসা, তার পেছনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হলে ঢাকার নারীসমাজে জাগরণ আসত আরো দেরিতে।”
তিনি আরো লিখেছেন, “নারীসমাজে প্রগতির যে ছোঁয়া লাগে, তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দান ছিল সবচেয়ে বেশি। মেয়েরা সভা-সমাবেশে ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনেক বেশি সংখ্যায় যোগদান করতে থাকে।
রক্ষণশীলদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করতে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে নবাববাড়ি ও আরও দু-চারটি পরিবারের মহিলারা সমাজসেবার আগ্রহ দেখান।”
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।
ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন---সব ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে।
আর এসব আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল একটি রক্ষণশীল সমাজের বিচারে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা বলছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেটি প্রধানত করেছে সেটি হচ্ছে একজন নারীর পাবলিক ওপিনিয়ন তৈরি হতে সাহায্য করেছে।
এই যে মতামত দেয়া, সে ব্যাপারটিই একশো বছর আগে এ অঞ্চলের নারীর ছিল না। এরপর এখন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী বিষয় থেকে খেলাধুলা, সামরিক বাহিনী থেকে বিমানচালনা---সব ক্ষেত্রেই যে নারীর অংশগ্রহণ আজকে দেখা যায় সমাজে সে অবস্থাটি তৈরির পেছনে উচ্চশিক্ষিত ও অগ্রসর নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা আছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা