অপরাধবিজ্ঞানে অনিয়ম, নেই ৮৬ লাখ টাকা খরচের বিল-ভাউচার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষণ বিভাগ। পাঁচ বছরের আর্থিক লেনদেন নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রায় ৮৬ লাখ টাকার বেশি খরচের বিল-ভাউচার নেই। যেসব ভাউচার রয়েছে সেগুলোর ৯৫ শতাংশেই কারো সই পাওয়া যায়নি। বড় খরচের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিটিরও কোন অনুমোদন নেই।
অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালকের কার্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অডিট শাখার প্রতিবেদনের এ চিত্র ওঠে এসেছে। চলতি বছরের ১ মার্চ এ প্রতিবেদন জমা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৫ বছর ১ মাস সময়ের লেনদেন খতিয়ে দেখা হয়।
এর আগে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক জিয়া রহমান। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ বিভাগের নতুন দায়িত্ব নেন খন্দকার ফারজানা রহমান।
অডিট শাখার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ড. জিয়া রহমান বিভাগটির চেয়ারম্যান পদে থাকাকালীন নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে লেনদেন করেছেন। শ্রেণীকক্ষ সংস্কারের নামে ৪২ লাখ, ভারত ও মিয়ানমার ভ্রমণ বাবদ ১১ লাখ, ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের নামে ৮ লাখ, কনফারেন্সের অনুদান বাবদ ৯ লাখ, ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের আয়োজন বাবদ ১০ লাখ এবং কম্পিউটার ও অন্যান্য মালপত্র ক্রয় বাবদ ৬ লাখ টাকার বেশি অর্থ নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যয় করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সান্ধ্য কোর্সের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মানী বা পারিশ্রমিক দেওয়ার কোনো নীতিমালা শুরুতে গ্রহণ করেনি এই বিভাগ। পরে নীতিমালা করা হলেও একাডেমিক কমিটিতে তা অনুমোদন করা হয়নি। এ খাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
আবার যখন নীতিমালা হয়েছে তখন চেয়ারম্যানের সম্মানী ভাতার ক্ষেত্রে সে নীতিমালা মানা হয়নি। অন্য বিভাগীয় চেয়ারম্যানরা সাধারণত তিন হাজার টাকা করে সম্মানী পান। কিন্তু জিয়া রহমান মোট ১৭ লাখ টাকা সম্মানী নিয়েছেন। বিভাগের সূত্র জানায়, বিভাগের একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই তিনি সান্ধ্য কোর্সের পরিচালক হিসেবে ২৫ হাজার টাকা এবং চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা করে নেন।
এতে বলা হয়েছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভাগের দুজন শিক্ষকের নামে ১ কোটি টাকার এফডিআর খোলা হয়েছে। কোনো ক্রয়েরই ভ্যাট ও কর দেওয়া হয়নি। ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ভ্যাট বাবদ প্রায় ৮ লাখ ৩৮ হাজার ২৭৩ টাকা এবং কর বাবদ ২ লাখ ৫৫৯ টাকা। পরীক্ষাসংক্রান্ত ব্যয়ে শিক্ষকদের সম্মানী থেকে ১০ শতাংশ হারে আয়কর কাটা হলেও তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে আয়কর বাবদ ১৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। আপ্যায়ন ও আনুষঙ্গিক ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি।
বিভাগটির বর্তমান চেয়ারম্যান ফারজানা রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ বিভাগের কোনো হিসাব নিরীক্ষা হয়নি। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে তা করার উদ্যোগ নেন। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি গত সোমবার বিভাগের একাডেমিক কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে জিয়া রহমানও ছিলেন। তিনিসহ একজন শিক্ষক প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেননি। বাকি দুজন শিক্ষক গ্রহণ করেছেন। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি তাঁরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের কাছে পাঠাবেন।
তবে বিভাগটির সাবেক চেয়ারম্যান ও অনিয়মে অভিযুক্ত অধ্যাপক জিয়া রহমান পুরো প্রক্রিয়াটি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও মানহানির জন্য করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ৭৩–এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিভাগের হিসাব নিরীক্ষা করার এখতিয়ার চেয়ারম্যানের নেই। চেয়ারম্যান যে নিরীক্ষা করাচ্ছেন, তা বিভাগের কোনো শিক্ষক জানতেন না। কোনো কমিটিকেও জানানো হয়নি। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় তিনি যেসব কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলেন তার বড় অংশই ‘মিসিং’ বলে দাবি তার।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিভাগের সব ধরনের কাজে একাডেমিক কমিটির অনুমোদন বা মতামত নিতে হবে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেই এ কমিটিগুলোকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, খরচ বিভাগ করুক বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করুক, এটা জনগণের টাকা। প্রতিটি পয়সার হিসাব থাকা উচিত, না থাকলে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে অপরাধ। আর অপরাধ হলে, অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেই এর প্রতিকার আছে। দায়ী ব্যক্তির কাছ থেকে সেই টাকা আদায় করতে হবে এবং শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।