৫ বছরে হামলার শিকার ২৫০ শিক্ষার্থী, আশ্বাসেই আটকে আছে বিচার
গতকাল শুক্রবার রাতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে স্থানীয়রা। এর আগে পরিবহন শ্রমিকদের দ্বারা রাতের অন্ধকারে হামলার শিকার হয়েছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই দুই ঘটনার পর সমগ্র দেশ জুড়েই সমালোচনার ঝড় বইছে।
তবে শুধু এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই নয় গত ৫ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের দ্বারা প্রায় ১৭ টি হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং এতে আহত হয়েছেন প্রায় ২৫০ শিক্ষার্থী। দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এমত তথ্য পাওয়া গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে স্থানীয়রা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে হল খুলে দেয়ার দাবিতে আন্দোলন চলছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়: বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকায় ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতের অন্ধকারে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মেসে হামলা চালিয়েছে পরিবহন শ্রমিকেরা। এ হামলায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়েরকৃত মামলার প্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত দুই পরিবহন শ্রমিককে আটক করেছে পুলিশ।
নোবিপ্রবি: নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে প্রায় তিনবার বহিরাগতদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ২০১৬ এর ১৭ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে, ২০১৭ এর ৫ নভেম্বর এক ছাত্রী উত্ত্যক্ত করাকে কেন্দ্র করে এবং ২০১৮ এর ১১ এপ্রিল কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বহিরাগতরা হামলা করেছিলো। এসকল ঘটনার মধ্যে প্রথম ঘটনায় ২০ জন, দ্বিতীয় ঘটনায় ৭ জন এবং তৃতীয় ঘটনায় ৪ জন আহত হয়। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালের হামলার ঘটনায় স্থানীয়দের সাথে সমঝোতা হলেও বাকি দুটো ঘটনার কোনো বিচার হয়নি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৫ বছরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে পাঁচবার বহিরাগত কর্তৃক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ২০১৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির হামলায় ২০ জন, ২০১৭ এর ১৭ ডিসেম্বরের হামলায় আটজন ২০১৮ এর ১১ অক্টোবরের হামলায় একজন, ১৩ মে এর হামলায় একজন এবং ২০১৯ এর ১৮ ফেব্রুয়ারির হামলায় দুই শিক্ষার্থী আহত হয়। কুবির একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এসকল ঘটনার মধ্যে দু-একটিতে তাৎক্ষণিকভাবে হামলাকারীকে আটক করা হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি।
বশেমুরবিপ্রবি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা ২০১৮ এবং ২০১৯ এ দু'বার স্থানীয়দের কর্তৃক হামলার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২০১৮ এর ৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মসজিদে মাইকিং করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং গোবরা এলাকার বিভিন্ন ছাত্রাবাসে হামলা চালায় স্থানীয়রা। এ ঘটনায় প্রায় ২৫ শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলো। এছাড়া ২০১৯ এর ২১ সেপ্টেম্বর উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময় গোবরা, নবীনবাগ এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় স্থানীয়রা। এ ঘটনায় প্রায় ৩০ শিক্ষার্থী আহত হয়। হামলার প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ এর হামলার ঘটনায় স্থানীয়দের সাথে সমঝোতা করা হয় আর ২০১৯ এর হামলার ঘটনায় মামলা করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
যবিপ্রবি: যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ এবং ২০২০ সালে দু'বার হামলার ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে ২০১৭ এর ৫ অক্টোবর রাত সাড়ে ১২ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে হামলা চালায় বহিরাগতরা। এ হামলায় ৩০ শিক্ষার্থী আহত হয়। এছাড়া ২০২০ এর ১৯ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে আমরণ অনশনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে বহিরাগতরা। এ হামলায় আহত হয় ১২ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন এসকল ঘটনায় বিচারের আশ্বাস দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো হামলাকারীকে বিচারের আওতায় নেয়া হয় নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ এর ২৮ অক্টোবর বহিরাগতদের হামলায় আহত হন চবির দুই শিক্ষার্থী। চবির শিক্ষার্থীরা জানান, অন্যান্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের দৌরাত্ম বেশি। বহিরাগতদের কর্তৃক হামলা, ছিনতাই, ইভটিজিং বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হলেও এসকল ঘটনায় শাস্তির উদাহরণ খুবই কম।
হাবিপ্রবি: হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে বহিরাগতদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় প্রায় ৫ শিক্ষার্থী আহত হয়।
রাবিপ্রবি: রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় স্থানীয়রা। এ হামলায় চার শিক্ষার্থী আহত হয়। রাবিপ্রবির একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ ঘটনায় বিচারের আশ্বাস দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর প্রতিনিয়ত এধরণের হামলার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান বলেন, “আমি মনে করি মূলত দুটো কারণে এধরণের হামলার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে একটি হলো শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব আর অপরটি হলো বিচারহীনতা।”
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো: রায়হান বলেন, “বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটলেও হামলাকারীদেরকে কখনোই শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। আর এর ফলেই হামলাকারীরা এধরণের হামলা করার সাহস পাচ্ছে।”
বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষার্থী মো: ফিরোজ বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব ও সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে হামলাকারীরা বারবার হামলা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। আর এর ফলেই এধরণের হামলার ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলছে।”
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল কবীর ফারহান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের উপর নারকীয় হামলার ঘটনায় যেমন ভাবে দায়ী বিচারহীনতার সংস্কৃতি তেমনি ভাবে এসব ঘটনা বড় হওয়ার কারণ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে প্রশাসনের অসহযোগিতামূলক আচরণ। শুরুতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ না থাকায় শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া হয়ে পড়ে এবং এসব ঘটনা বড় হতে থাকে। আর বারবার পার পেয়ে এসবে উদ্ভুদ্ধ হতে থাকে অপরাধীরাও।