অলিম্পিক ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন ঢাবি ছাত্র মিরাজ
পাকিস্তান অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী বাঙালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বলতম অ্যাথলেট শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মিরাজ উদ্দিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছেন। বিজয়ের ৪৯তম বছরে জাতীয়ভাবে তো নয়ই; তার জন্মভূমি মানিকগঞ্জেও আলাদা করে কেউ তাকে স্মরণ করেনি। তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের অন্যতম সেরা এই ক্রীড়াবিদ অলিম্পিকে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য।
দেশের অন্যতম সেরা এই অ্যাথলেটের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাটিকান্দা গ্রামে। শরীফ উদ্দিন আহমেদ ও মোসাম্মত হাজেরা খাতুনের জ্যেষ্ঠ পুত্র তিনি।
মিরাজের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হরিরামপুরের লেছরাগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। প্রাইমারি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন হরিরামপুরে পাটগ্রাম অনাথবন্ধু হাইস্কুলে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ করে ভর্তি হন ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটে। এরপর জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্কুল, কলেজ ও জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া আসরসগুলোতে মল্লক্রীড়ার হার্ডলস, পোল ভল্ট ও দীর্ঘ লম্ফ খেলায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জন করেন এবং এসব খেলায় জাতীয় রেকর্ডের অধিকারী ছিলেন তিনি।
মিরাজ উদ্দিনের খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। এ বছর তিনি আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে পোলভল্ট, হার্ডলস এবং দীর্ঘ লম্ফ ইভেন্টে প্রথম হয়েছিলেন। এই সাফল্য তিনি ১৯৬৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও ধরে রাখেন, তিনি এই প্রতিযোগিতায়ও ব্যক্তিগত শিরোপা জিতেছিলেন। ১৯৬৫ সালে আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ কলেজের হয়ে ১১০ মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট এবং দীর্ঘ লম্ফে তৎকালীন নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত দশম ‘পাকিস্তান অলিম্পিক’ নামে পরিচিত পাকিস্তানের জাতীয় ক্রীড়ানুষ্ঠানে পোলভল্ট খেলায় বাঁশের পোল দিয়ে ১২ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা অতিক্রম করে পাকিস্তান অলিম্পিক রেকর্ড স্থাপন করেন। সেই প্রতিযোগীতায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি একমাত্র স্বর্ণপদক বিজয়ী ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেও মিরাজের অর্জন অনেক। পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা অ্যাথলেটের স্বীকৃতিও। শুধু ক্রীড়াঙ্গনেই নিজেকে আটকে রাখেননি মিরাজ। অসাধারণ জনপ্রিয়তা আর বন্ধু বাৎসল্য দিয়ে রাজনীতির মাঠও জয় করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিরাজউদ্দিন ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭০ সালেই তিনি দ্বাদশ পাকিস্তান জাতীয় ক্রীড়ানুষ্ঠানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াদলের পতাকা হাতে কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মল্লক্রীড়ায় সাফল্য পাওয়ায় তিনি ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তান দলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন তিনি।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ছোটভাই এ কে এম সিরাজ উদ্দিনসহ মানিকগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সাবেক ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং গেরিলা হিসেবে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। তার অংশ নেয়া যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সিংগাইর উপজেলায় সংঘটিত গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। ২৮ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে তিনি তবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে লড়াই করেছিলেন। এই যুদ্ধে ৮১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিল। ২ নভেম্বর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বানিয়াজুরি সেতুতে ডায়নামাইট বসাতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে মানিকগঞ্জের বন্দি শিবিরে না রেখে ঢাকার সেনানিবাসে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর সকালে আল বদর বাহিনীর পরিচালক মেজর মোস্তাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিরাজকে মুক্ত করে জিপে তুলে নিয়ে যান। সেই থেকে তিনি আজও নিখোঁজ রয়েছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর মিরাজউদ্দিন ও অপর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তপন চৌধুরীর নামে মানিকগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামের নাম ‘শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়াম’ রাখা হয়। প্রাপ্তি বলতে শুধু এতটুকুই। প্রবীণেরা মোটামুটি চিনলেও নতুন প্রজন্মের কাছে শুধু মিরাজ নামটিই জানা। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র সম্পর্কে জানে না ছিটেফোঁটাও। জানাবার কোনও উদ্যোগও নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা পুরো বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনা একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রকে মিরাজ উদ্দিন। পাকিস্তান আমলে মিরাজের মত উজ্জ্বল নক্ষত্র ক্রীড়াঙ্গনে খুব বেশি ছিল না। যাকে নিয়ে আজ ১৭ কোটি বাঙালি গর্ব করতে পারতো। সেই গর্বের মিরাজ আজ তার রক্তে স্বাধীন ভূমিতেই বিস্মৃত এক অতীত। অথচ তিনি পারতেন যুদ্ধে অংশ না নিয়ে দেশের প্রথম শ্রেণির একজন ক্রীড়াবিদ হতে।