করোনাকালে নাজুক জাবির ছাত্র রাজনীতি, বাড়ছে কোন্দল-হতাশা
করোনা মহামারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) বন্ধ দীর্ঘ সাত মাস ধরে। বন্ধ ছাত্ররাজনীতিও। ফলে অলস সময় কাটছে ছাত্রনেতাদের। অনেকেই হতাশ হলেও কিছু নেতা করোনাকে মূল্যায়ন করলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। এসময় তাদের শিক্ষাজীবন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি ও উপলদ্ধি তৈরি হয়েছে, যা ছয় মাস আগে কল্পনাও করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন তারা।
ছাত্রনেতারা বলছেন, বর্তমান অনিশ্চিত প্রেক্ষাপট তাদের কোথায় নিয়ে গিয়ে ঠেকায়, তা দেখতেও মুখিয়ে রয়েছেন তারা। তবে একটি বিষয় সবাই স্বীকার করছেন ‘হালে পানি নেই জাবির ছাত্র-রাজনীতির’। তবে এরমধ্যেও অনেক ছাত্রনেতা ক্যাম্পাসের কাছাকাছি থাকতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন গেরুয়া, ইসলামনগর ও আমবাগান এলাকায় মেস ভাড়া নিয়ে আছেন।
জাবিতে নাজুক অবস্থায় ক্ষমতাসীনরা (ছাত্রলীগ)
গ্রুপিং, সংঘর্ষ, উপাচার্যের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ, নিয়োগ বাণিজ্য, সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগের মতো ঘটনায় গত বছর গণমাধ্যমসহ দেশজুড়ে সমালোচিত ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। প্রায় তিন বছর হতে চলল জাবি ছাত্রলীগ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হল কমিটিও দিতে পারেনি বর্তমান কমিটি। ফলে ক্ষোভ, হতাশা আর রাজনৈতিক কোন্দলে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন অনেকে।
এরইমধ্যে অনেক নেতাকর্মী পড়াশোনা শেষ করে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংসার করছেন; কেউ বা হয়েছেন ‘মাইনাস’। আবার কমিটি না হওয়ায় ছাত্রত্ব শেষ হওয়া অনেক নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। ফলে কমিটিতে অছাত্রদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি দেখা দিয়েছে নেতৃত্ব সংকটও। ফলে পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ।
এ অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্প থেকে শাখা ছাত্রলীগের কমিশন বাণিজ্যের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসে নেই সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চল। যদিও পরে তিনি কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিকে বিদায় জানান। এরপর থেকে সভাপতির একক সিদ্ধান্তে খুড়িয়ে চলছে শাখা ছাত্রলীগ।
কমিটি নিয়েও প্রকাশ্যে বিবাদে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিট। গত ৩০ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে বাইক শোডাউনের মাধ্যমে এই বিবাদ প্রকাশ্য রূপ নেয়। এদিনই সভাপতি জুয়েল রানার অনুসারীরাই তাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। বিবাদের পর অনেকটা একা হয়ে পড়েছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি। তার পাশে নিজ হলের নেতাকর্মী ছাড়া আর কেউ নেই বলে জানা গেছে। আর ছেলেদের বাকি সাতটি হলের নেতাকর্মীরাই সভাপতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা শুরু করেছেন। করোনার মধ্যেও তা অব্যাহত রয়েছে।
তবে কর্মসূচী পালনকারী অনেক নেতাকর্মীরা দাবি করেন, ‘সভাপতি ছাড়া আমরা একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম তথা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ব্যানারে মিলিত হয়েছি। এই উপস্থিতি জানান দেয়, জাবি ছাত্রলীগ আজ নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছে। মনে হচ্ছে, ছাত্রলীগ প্রাণ ফিরে পেয়েছে।’
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জুয়েল রানাকে সভাপতি ও আবু সুফিয়ান চঞ্চলকে সাধারণ সম্পাদক করে জাবি ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১৭ সালের এপ্রিলে এক বছর মেয়াদে ২১৪ জনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়। এরপর আড়াই বছরের বেশি সময়েও এ কমিটি কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী হল কমিটি দিতে পারেনি। ফলে উদীয়মান নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। এ ছাড়া বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বেশির ভাগই রাজনীতিতে সক্রিয় নেই।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ৮০ জনের বেশি নেতা ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রচার সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদক, ২৫ জন সহসভাপতি ও আটজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রয়েছেন। যাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় তাঁদের মধ্যে ৪১তম আবর্তন ও ৪২তম আবর্তনের বেশির ভাগ নেতাকর্মী শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছেন।
তাঁদের অনেককেই কোনো পদবি ছাড়াই শিক্ষাজীবন শেষ করতে হয়েছে। বর্তমানে যাঁরা আছেন, সময়ের সঙ্গে সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাওয়ায় তাঁরাও ছাত্রলীগের বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। ফলে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কমিটি নিয়ে নাকাল জাবি ছাত্রদল
করোনা মহামারির মধ্যেই গণমাধ্যমে গুঞ্জন উঠে, আগস্টের মধ্যেই হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রদলের কমিটি। কমিটিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানও জানান দিচ্ছিল শাখা ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এতে অনেক নেতা এতদিন সাংগঠনকি কর্মকাণ্ড নিস্ক্রিয় থাকলেও কমিটি হতে যাচ্ছে এমন গুঞ্জনে ফের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয়েছিলো। অনেকেই যোগাযোগ শুরু করেছিলো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে।
এমনকি লন্ডনেও বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চলছিলো। সব আশায় গুড়েবালি দিয়ে কমিটি গঠনের খবর গুঞ্জনের পর্যায়েই শেষ হয়। যেন মরুভূমিতে মরীচিকার পেছনে ছুটছে জাবি ছাত্রদল। সেসময় ছাত্রদলের একাধিক সূত্রে জানা যায়, করোনার মধ্যেই জাবি ছাত্রদলের ৩১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি হতে পারে। কমিটির মেয়াদ হবে তিনমাস। এই আহবায়ক কমিটি গঠিত হলে, তাদের কাজ হবে- কাউন্সিলের আয়োজন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়ার ব্যবস্থা করা।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাংগঠনিক টিম ঢাকা ১(ক) এর টিম লিডার হাফিজুর রহমান হাফিজ বলেন, ‘আমরা জাবি ছাত্রদলের ৩১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। শিগগিরই কমিটি দিতে পারবো বলে আশা রাখছি।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের সোহেল রানাকে সভাপতি ও একই বিভাগের ৩৮তম ব্যাচের আবদুর রহিম সৈকতকে সাধারণ সম্পাদক করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রদলের ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়।
অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছাত্র ইউনিয়ন
করোনার মধ্যে জনকল্যাণমূলক কাজ ও জনতুষ্টির কেন্দ্রীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলো জাবি সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। আভ্যন্তরীণ কোন্দল ছাড়াই নিয়মিত কমিটি দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন ও দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে শাহবাগ ও ঢাকার রাজপথে সামনের সারিতে অবস্থান করে জাবি নেতা-কর্মীরা।
উল্লেখ্য, এ বছরের ১০ জানুয়ারিতে জাবি সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের ২৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে সভাপতি পদ লাভ করেন মিখা পিরেগু এবং রাকিবুল রনি সাধারণ সম্পাদক হয়।
রাস্তায় সক্রিয় ছাত্রফ্রন্ট
চলমান করোনা মহামারির মধ্যে দেশের জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে সক্রিয় থাকতে দেখো গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতাকর্মীদের। এছাড়াও করোনার মাঝে ছাত্র কল্যাণ কাজেও তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় পর্যায়ে ছিলো। এ বছরের ১৭ জানুয়ারিতে তাদের আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী শোভন রহমানকে আহবায়ক এবং ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়।
ছন্নছাড়া মার্কসবাদী ছাত্রফ্রন্ট
সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্টের (মার্কসবাদী) কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৪ ব্যাচের মাহাথির মুহাম্মদকে সভাপতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সুদীপ্তকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিলো। কিন্তু করোনায় তাদের কোন ধরনের ছাত্রকল্যাণ মূলক কাজ পরিলক্ষিত হয়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার হতে দেখা গেছে তাদের।
এদিকে গুঞ্জন রয়েছে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগের এবং কেন্দ্রীয় সংগঠন হতে জাহাঙ্গীরনগর সংসদ বাতিলের। চলমান এই সংকটকালীন পরিস্থিতিতে অনেক নেতাকে তাই ক্যারিয়ার কেন্দ্রীক ব্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে। অনেকেই আবার ছাত্ররাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ। সকলেরই একটি কামনা দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক এবং ক্যাম্পাসে প্রাণ ফিরুক। তবেই ছাত্রনেতৃত্বের হতাশা দূর হবে।