ফজিলাতুন্নেসা জোহার ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী

ঢাবির প্রথম মুসলিম ছাত্রীর স্মরণে জাবিতে আবাসিক হল

ফজিলাতুন্নেসা জোহা  ও জাবির হল
ফজিলাতুন্নেসা জোহা ও জাবির হল  © ফাইল ফটো

১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাস। উপমহাদেশের নবীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন ক্যাম্পাসে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই। প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া কোনো নারীর সঙ্গে কথা বললে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। এমনই এক দিনে কোলকাতা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে এলেন উদয়ীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কার্জন হলের সামনে তিনি শাড়ি পরিহিত মেয়ে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। নিয়মের তোয়াক্কা ছাড়াই কথা বললেন নজরুল। এর তিনদিন পর ঢাবি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ হন ভবিষ্যতের জাতীয় কবি।

যেই মহিয়সীর সাথে কথা বলে নিষিদ্ধ হলেন কবি, তিনি হচ্ছেন ঢাবির প্রথম মুসলিম ছাত্রী, প্রথম স্নাতক ডিগ্রীধারী, প্রথম মহিলা অধ্যক্ষ। যার কাছে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখাত হয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি। তিনিই উপমহাদেশে মুসলিম নারীদের মধ্যে প্রথম যিনি বিদেশ থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন।

বাংলার এই অসামান্য নারীর কদর বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল কিংবা কামিনী রায়দের মতো উল্লেখযোগ্য নয়।

তার অর্জনের স্বীকৃতিতে আমাদের বদন্যতা ফুটে উঠেছে। তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতেও হচ্ছেনা কোন স্মরণ সভা। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নারী অধিকারে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকার অধিকারী সবুজের এই নগরে ১৯৮৭ সালে নির্মাণ করা হয়েছে মেয়েদের একটি আবাসিক হল।

এব্যাপারে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ টি এম আতিকুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’কে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরে ১৯৮৭ সালে যখন আল বেরুনী ও নওয়াব ফয়জুনেন্সা হলে শিক্ষার্থীদের সংকুলান হচ্ছিলোনা তখন এই ভবনে শিক্ষার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হয় এবং হলের নামকরণ ফজিলাতুন্নেসা করা হয়।’ তবে ফজিলাতুন্নেসার স্মরণে সেখানেও কোন ধরনের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয় না বলে জানালেন তিনি।

এবিষয়ে হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সচেতন ধারণা পোষণ করেনা। অনেকেরই ফজিলাতুন্নেসা সম্বন্ধে সঠিক জানাশোনা নেই। কিছু শিক্ষার্থী আবার বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সাথে ফজিলাতুন্নেসা জোহাকে গুলিয়ে ফেলেন।

আজ বুধবার (২১শে অক্টোবর) এই ফজিলাতুন্নেসা জোহার ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী।

ফজিলাতুন্নেসা পরিচিতিঃ

ঢাকা ইডেন কলেজের এই অধ্যক্ষা শুধু অসামান্য সুন্দরীই ছিলেন না তিনি ছিলেন গনিতবিদ্যায় এম এ। ১৯২৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বাংলার রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থাকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে অসম সাহস ও উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রবল আকাংখায় বোরকা ছাড়া বহুবিধ অত্যাচার সহ্য করে উওরসুরী মুসলিম মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেন ফজিলতুন্নেসা। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়। আমাদের ব্যর্থতা আমরা এই গুণী নারীকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। বর্তমান প্রজন্ম তাকে খুব একটা জানেনা। এমনকি বাংলাদেশেও ফজিলতুন্নেসাকে স্মরণ করা হয় না। ১৯৭৬ সালের ২১ অক্টোবর ফজিলতুন্নেসা মৃত্যুবরণ করেন।

ফজিলাতুন্নেসা ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহ (বর্তমানে টাঙ্গাইল) জেলার করটিয়ার ‘কুমল্লীনামদার’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওয়াহেদ আলী খাঁ। করোটিয়ার জমিদার বাড়িতে সামান্য একটি চাকরি করতেন ওয়াহেদ আলী খাঁ। ফজিলতুন্নেসার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই তার শিক্ষাজীবন শুরু। ৬ বছর বয়সে ফজিলতুন্নেসা করটিয়ার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। মাইনর পাস শেষে সামাজিক ও পারিবারিক বাধা অতিক্রম করে ১৯১৭ সালে তিনি ফজিলতুন্নেসাকে ঢাকা নিয়ে আসেন তার বাবা। সে সময়ের একমাত্র সরকারী বালিকা বিদ্যালয় `ইডেন স্কুলে` ভর্তি করে দেন। কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের পুরস্কার তিনি পান। ১৯২১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক ১৫ টাকা হারে বৃত্তি পান। তখন থেকে লোকের মুখে মুখে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর ১৯২৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন এবং শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। তারপর কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়ার জন্য যান। এই কলেজে তখন তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম ছাত্রী। ১৯২৫ সালে ডিসটিংশানসহ বিএ পাশ করেন ফজিলাতুন্নেসা। ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে মিশ্র বিভাগে এমএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান দখল করেন। এমএ পাশ করার পর ১৯২৮ সালে কিছুদিন তিনি ঢাকার ইডেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ফজিালতুন্নেসা ইংল্যান্ড যান।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে একজন মেয়েকে বিলেত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি নিজ চেষ্টায় ‘ষ্টেটস স্কলারশীপ’ যোগাড় করেন। এ ব্যাপারে সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন ও খান বাহাদুর আবদুল লতিফ তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। ফলে তার বিলেত যাওয়ার পথ সুগম হয়। কিন্তু বাবার অসুখের খবর পেয়ে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোর্স শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর আর তার বিলেত যাওয়া হয়নি। লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান এবং পরে কলকাতার বেথুন কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি এ কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান এবং একই সঙ্গে কলেজের উপাধ্যক্ষা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি বেথুন কলেজের চাকরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় ঢাকা চলে আসেন এবং ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম নারী অধ্যক্ষ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইডেন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্‌র পুত্র প্রথম বাঙালি সলিসিটর শামসুজ্জোহার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন ফজিলাতুন্নেসা। বিলেতে থাকাকালে তার সাথে শামসুজ্জোহার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খার মধ্যস্থতায় জোহার সাথে ফজিলতুন্নেসার বিয়ে হয়। ফজিলাতুন্নেসা জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন নিঃসঙ্গ নির্জনে।


সর্বশেষ সংবাদ