গবেষণায় জালিয়াতি: চার ধরনের ব্যবস্থা রেখে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত

ঢাবির ডিনস কমিটির সিদ্ধান্ত

চার ধরনের ব্যবস্থা রেখে গবেষণা জালিয়াতির অধ্যাদেশ অনুমোদন
চার ধরনের ব্যবস্থা রেখে গবেষণা জালিয়াতির অধ্যাদেশ অনুমোদন  © টিডিসি ফটো

জালিয়াতির লাগাম টানতে নতুন এবং যুযোপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রণয়ন করা হচ্ছে অধ্যাদেশ। তিন ধাপ পেরিয়ে সিন্ডিকেটের অনুমোদনের মাধ্যমে পাস হবে অধ্যাদেশ। আগামী সপ্তাহে এই নীতিমালা চূড়ান্ত করে উপাচার্যকে পাঠানো হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

এর আগে গবেষণা জালিয়াতি প্রতিরোধে জন্য অর্ডিন্যান্স তৈরি করতে গঠিত হয়েছে তিন সদস্যের কমিটি। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমকে সমন্বয়ক করে গঠিত কমিটিতে অন্য দু’জন হলেন- আইন অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. হাসানুজ্জামান।

এদিকে, রবিবার ডিনস কমিটির বৈঠকে খসড়া অধ্যাদেশ উপস্থাপন করেছে ড. সাদেকা হালিমের কমিটি। উপস্থাপিত অধ্যাদেশটি ডিনস কমিটিতে পাস হয়েছে। এর কপি প্রত্যেক অনুষদের ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং দুই উপ-উপাচার্যকে দেয়া হয়েছে। উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল কোনো সংশোধনী বা ভুল থাকলে কমিটির সাথে বসে তা সমন্বয় করবেন। এরপর তা একাডেমিক কাউন্সিলে যাবে। সেখানে পাস হলে সিন্ডিকেটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অধ্যাদেশে স্থান পাবে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. হাসানুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যাদেশ প্রণয়ণের অংশ হিসেবে খসড়া নীতিমালা ডিনস কমিটিতে পাস হয়েছে। এর কপি ডিনদেরকেও দেয়া হয়েছে। উপস্থাপিত নীতিমালা উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) কাছে জমা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আরো খুঁটিনাটি কোনো ভুল-ভ্রান্তি বা সংশোধনী থাকলে সেটা পাঠাতে বলা হয়েছে। তারপর উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) কমিটির সদস্যদের সাথে বসে তা চূড়ান্ত করে ফেলবেন। পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে একাডেমিক কাউন্সিল। তবে এখনো কাউন্সিলের সভার দিন ধার্য করা হয়নি।

নীতিমালায় তিন ধরনের গবেষকের বিষয়ে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এ তিন শ্রেণি হলেন- বর্তমান বা অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক। আর এমফিল, পিএইচডি এবং মাস্টার্সের গবেষণার ওপর মূল্যায়ন করা হবে। তাদের এমফিল, পিএইচডি, মাস্টার্সের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা আরোপ করা হয়েছে। কত শতাংশ নকল হলে সেটা গ্রহণ করা হবে, কতো হলে গ্রহণ করা হবে না; কিংবা কতো শতাংশ হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে তাও এখানে লিপিবদ্ধ করা আছে।

আবার বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কিছু সুযোগ রাখা হয়েছে। যারা পাস করে গেছেন তাদের থিসিস নিয়ে যদি কোনো অভিযোগ ওঠে সেটা নিয়েও একটা ব্যবস্থা আছে। বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্যও একটা শর্ত দেয়া আছে, কত শতাংশ নকল হলে থিসিস গ্রহণ করা হবে, কতো শতাংশ থাকলে তার থিসিসি বাতিল হবে।

নকলের হার অনুযায়ী চার ধরেনর ব্যবস্থা:
চার ধরনের ব্যবস্থা রেখে গবেষণা জালিয়াতি প্রতিরোধ কমিটির খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের নকলের জন্য এক মাসের সময় বেধে দিয়ে ভুল সংশোধনের সুযাগ রাখা হয়েছে। আর সর্বোচ্চ পর্যায়ের জন্য চাকরি থেকে অব্যাহতিরও (টারমিনেশন) সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে পদাবনতির (ডিমোশন) সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রথমত, ০ থেকে ২০ শতাংশ নকল হলে সেটার জন্য ‘নো অবজেকশন’, ‘নো পেনাল্টি’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সেটার ক্ষেত্রে থিসিস বাতিল হবে না। কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হবে না। এ নিয়ম বর্তমান, সাবেক শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যও প্রযোজ্য।

দ্বিতীয়ত, ২০ থেকে ৪০ শতাংশের জন্য এক মাস সময় বেধে দিয়ে থিসিসি সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ২০ শতাংশের  মধ্যে এনে থিসিস পুনরায় সাবমিট করতে বলা হয়েছে। তবে যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে গেছে ক্যাম্পাস থেকে কোনো কারণে দূরে অবস্থান করছে, তাদের জন্য সময় বাড়িয়ে তিন মাস করা হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে সংশোধিত থিসিস জমা দেবেন তারা। এখানেও খুব বড় কোনো শাস্তি রাখা হয়নি।

তৃতীয়ত, যাদের গবেষণায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ নকল তাদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা একবছরের মধ্যে থিসিস জমা দিতে পারবে না। পরের ব্যাচের সাথে থিসিস জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের এক্সপেলড (বহিষ্কার) না করে ডিবার (অর্থাৎ থিসিস জমাদান থেকে বঞ্চিত বা নিষেধাজ্ঞা) করার সুপারিশ করা হয়েছে।

চতুর্থত, ৬০ থেকে ১০০ এর মধ্যে হলে দুই বছরের জন্য ডিবার করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই দুই বছরের মধ্যে তিনি থিসিস জমা দিতে পারবেন না। তবে থিসিস সংশোধন করে নকলের পরিমাণ ২০ শতাংশ বা তারও কমে নামিয়ে এনে দুই বছর পরে তা জমা দিতে পারবেন। এটা ছাত্রদের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হবে।

তবে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাদের জন্য রাখা হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে তাদের শাস্তি হলো ‘টারমিনেশন’ বা অব্যাহতি কিংবা ডিমোশন (পদাবনতি)। এম.ফিল বা পিএইচডির থিসিস হলে তার ডিমোশন বা টারমিনেশন হতে পারে। কারণ দেখা যায় একটা থিসিসে নকলের হার বেশি হলেও কিন্তু তার অন্যগুলো ভালো হয়েছে; সেক্ষেত্রে হয় তো টারমিনেশন না দিয়ে ডিমোশন দেয়ার কথা বিবেচনা করবে বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে শিক্ষকদের কারো মাস্টার্সের থিসিস নকল হলে সেক্ষেত্রে তাকে টারমিনেট করা হবে। কারণ তিনি তো মাস্টার্সের থিসিসেই চাকরি পেয়েছেন। এক্ষেত্রে ‘অল বেনিফিট সাসপেন্ড’ হলে তো অটোম্যাটিক্যালি তার চাকরিই চলে যায়। অর্থাৎ ওই ডিগ্রির জন্য যে সুবিধা পেয়েছেন সেটা ফেরত নেবে বিশ্ববিদ্যালয়। আর সেটা ফেরত নিলে তো তার চাকরিই থাকে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিষয়টিতে ডিনরা মতামত দেবেন। এরপর তা উপাচার্য হয়ে সিন্ডিকেটে যাবে। সেখানেই এটির অনুমোদন হবে।

আগামী সপ্তাহে এই নীতিমালা উপাচার্যের কাছে প্রেরণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিনস কমিটি সংযোজন-বিয়োজন সাপেক্ষেই এটা অনুমোদন করেছে। যদি কারো বিশেষ মতামত থাকে এবং সেটা যুক্তিসম্মত হয়; তবে তা আমলে নিয়ে চূড়ান্ত করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ