নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ: মৃত্যু নাকি হত্যা?
ঢাকা তখন সব কিছুতে পিছিয়ে। ছিলনা ইলেক্ট্রিসিটি, না ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, না ছিল পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজ। পিছিয়ে পড়া পূর্ববঙ্গের উন্নয়নে ধূমকেতু হয়ে এসেছিলো যেই লোকটি, তাঁর নাম নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ। শুধু সলিমুল্লাহই নন, পূর্ববঙ্গকে মুল ধারায় যোগ করতে তাঁর পুরো পরিবারের ভুমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।
স্যার সলিমুল্লাহর বাবা আহসানউল্লা ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকায় তথা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেদিন প্রথম বিজলি বাতির আলো জ্বলেছিল আহসান মঞ্জিলে। সেসময়ের ৩ লাখ টাকা মানে ছিল বিশাল রকমের হইরই কাণ্ড।
অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখকে তিনি নিজের দুঃখ মনে করতেন। দান-খয়রাত করে গেছেন অকাতরে। নওয়াব পরিবারের সন্তান হয়েও করেছেন সরকারি চাকরি। ১৮৯৩ সালে নেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি। শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর মনোনিবেশ। সেসময় পূর্ববঙ্গের শিক্ষার হার ছিল শোচনীয়। নিরক্ষরতা এতোই প্রকোপ ছিল যে শিক্ষিতের হারে পশ্চিমবাংলার ধারে-কাছেও ছিল না পূর্ববঙ্গ।
সে সময় কলকাতায় ৩ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে ছিল ১ জন শিক্ষিত, অথচ ঢাকায় ৮ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে ছিল মাত্র ১ জন শিক্ষিত। সমগ্র পুর্ববঙ্গের হিসাব করলে, প্রতি ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনই ছিল অশিক্ষিত।
পূর্ববঙ্গে যেহেতু মুসলিমরা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। তাই পরিসংখ্যান দেখে বোঝাই যাচ্ছে পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা সে সময় কতটা পিছিয়ে ছিল। অনুন্নত এই মুসলমান সমাজকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
নওয়াব হিসেবে দায়িত্ব পালনের শুরুতেই ঢাকার সব মহল্লায় তিনি স্থাপন করেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়। মুসলিমরা যে শুধু শিক্ষায় পিছিয়ে ছিল তা কিন্তু নয়, তারা ব্যবসা বাণিজ্য, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল।
নবাব সলিমুল্লাহই সেই মানুষ, যিনি সর্বপ্রথম পানীয় জল এবং টেলিফোন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আধুনিক ঢাকার জন্ম দেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েটের শুরু ১৮৭৬ সালে ঢাকা সার্ভে স্কুলের মাধ্যমে। এই সার্ভে স্কুলটিও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল স্যার সলিমুল্লাহর দান করা জমিতে। ১৯০২ সালে তৎকালীন সরকার সার্ভে স্কুলকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিলে অর্থাভাবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না। নওয়াব সলিমুল্লাহ সে সময় ১ লক্ষ ১২ হাজার টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিদ্যায়তনটির নামকরণ করা হয় ‘আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’। ১৯৪৭ সালে এটি কলেজে উন্নীত করে নামকরণ করা হয় "আহসানউল্লাহ ইন্জিনিয়ারিং কলেজ"। ১৯৬২ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিয়ে নাম দেয়া হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়’। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’।
পূর্ববঙ্গের ভাগ্যহত মানুষের উন্নতি এবং পশ্চাৎপদ জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে তিনিই প্রথম স্বতন্ত্র প্রদেশ সৃষ্টির দাবি জানান। তাঁর দাবির প্রেক্ষিতেই ইংরেজ সরকার ১৯০৫ সালে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ সৃষ্টি করে ঢাকাকে এর রাজধানী ঘোষণা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পশ্চিমবাংলার বর্ণবাদ হিন্দুদের চাপে ১৯১১ সালে পুর্ববঙ্গ প্রদেশ বাতিল করে ব্রিটিশ সরকার। পূর্ববঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৫ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছিলেন।
তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় আগমন করে তিন দিন অবস্থান করেন। ৩১ জানুয়ারি নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করেন। মুসলিম প্রতিনিধি দলটি বড়লাটের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো দাবি উত্থাপন করেন। তিনি প্রতিনিধি দলকে আশ্বাস দেন, নতুন প্রশাসনে মুসলমানদের স্বার্থসংরক্ষণ করা হবে এবং মুসলমানদের ক্ষতি পূরণের জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। লর্ড হার্ডিঞ্জ বুঝতে পারেন, বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় পূর্ববঙ্গের খুব ক্ষতি হয়েছে। পূর্ববঙ্গের টাকায় কলকাতায় বড় বড় স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হচ্ছিল। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা যে উন্নয়নের মুখ দেখতে শুরু করেছিল, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সেই আলো ফিকে হয়ে যায়। সলিমুল্লাহকে এসব বিষয় ভীষণ ভাবে ব্যথিত করেছিল।
অবশেষে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। লর্ড হার্ডিঞ্জের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণাকে মুসলমানরা বঙ্গ বিভাগ প্রত্যাহারের ক্ষতিপূরণ মনে করে নয়, বরং উচ্চশিক্ষা লাভের সোপান বিবেচনা করেই স্বাগত জানান। ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হওয়ায় তিনি বঙ্গভঙ্গ রদজনিত হতাশার অন্ধকারে তার স্বপ্নে দেখা উজ্জ্বল পূর্ব বাংলার অনেকটা আভা দেখতে পান। সেই ঘোষণাকে তিনি স্বাগত জানান।
পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের এতো প্রচেষ্টা দেখে বর্ণবাদ হিন্দু সমাজের তোপের মুখেও পড়তে হয় তাঁকে। সলিমুল্লাহর উপর বারবার চালানো হয় হামলা। এমনকি হত্যাচেষ্টাও করা হয় কয়েকবার।
যদিও এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিল সে সময়ের বর্ণবাদী হিন্দুরা। কিন্তু এসব নিয়ে ইতিহাসে স্বাক্ষীও আছে অনেক। এ নিয়ে ইতিহাস গবেষক সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার “আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খণ্ড” বইতে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করেছেন। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, “বঙ্গভঙ্গ আইন বহাল রাখার দাবিতে কুমিল্লার এক জনসভায় সলিমুল্লাহর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। পথিমধ্যে এক হিন্দুবাড়ি থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ফলে জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকা ফিরে আসেন। নবাবকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় অন্যপন্থা অবলম্বন করা হলো। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাঁধানো হলো। হিন্দুরা সশস্ত্র, মুসলমানরা নিরস্ত্র, তাই মুসলমান বেঘোরে প্রাণ হারাতে লাগল।” এমনকি শ্রী নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার স্মৃতিচারণমূলক ‘দি অটো বায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থে এসবের সত্যতা স্বীকার করেছেন। (সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদ : আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খণ্ড, পৃ. ২১৩)।
১৯১২ সালের মার্চ মাসে, কলকাতার গড়ের ময়দানে এক বিশাল জনসভা হয়। যারা কোন দিন কোনো মিটিং মিছিলে যান নাই, তারাও সেদিন গড়ের মাঠ গিয়ে ভর্তি করেন। সেই মিটিংয়ের সভাপতি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রিটিশ সরকারের ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিবাদে ডাকা হয়েছে সেই মিটিং। মিটিংয়ে প্রস্তাব পাশ হচ্ছে, ঢাকাতে যেনো ব্রিটিশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় না করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ বইতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এমনকি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে তাঁর ঢাকা সফর শেষে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করলে ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। শুধু ১ বার কিংবা ২ বার নয়, ব্রিটিশ সরকারকে তারা ১৮ বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতামুলক স্মারকলিপি দিয়েছিলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে ওপার বাংলার বড় বড় হিন্দুদের বিরোধিতা স্যার সলিমুল্লাহকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছিল। শেষ পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গের বর্ণবাদ হিন্দুদের বিরোধিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ভেস্তে যেতে চলেছিল। তিনি তড়িঘড়ি করে কলকাতায় বড়লাটের সাথে দেখা করতে যান।
ইতিহাসবিদ কবি ফারুক মাহমুদ বলেন, হিন্দুদের চক্রান্তের ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে বড়লাটের সাথে নবাবের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে বড়লাট নবাবকে অপমানজনক কথা বলেন। তার সহ্য হয়নি। নবাবের সাথে সব সময় একটি ছড়ি থাকত। সে ছড়ি দিয়ে নবাব বড়লাটের টেবিলে আঘাত করেন। এ নিয়ে চরম তির্যক বাদানুবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বড়লাটের ইঙ্গিতে তার দেহরক্ষী নবাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন এবং গুরুতর আহত হন। পরে নবাবের মৃত্যু হয়। নিশ্চিদ্র প্রহরায় নবাবের লাশ ঢাকায় আনা হয়। তার আত্মীয়স্বজনকেও লাশ দেখতে দেয়া হয়নি।১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি সামরিক প্রহরায় বেগম বাজারে তাকে দাফন করা হয়। (সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদ : আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২১)
কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়, সলিমুল্লাহ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এভাবেই ধামা চাপা দেয়া হয় একটি নক্ষত্র হত্যার রহস্যকে। ক্ষণিকের জন্য তাঁর স্বপ্ন থেমে গেলেও, ১৯২১ সালে তাঁরই দান করা জমিতে প্রতিষ্ঠা হয় স্যার সলিমুল্লাহর স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আফসোস তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর এই আত্মত্যাগ যুগ যুগ স্মরণ করবে আপামর জনতা।
লেখক: শিক্ষার্থী, আর্মি ইন্সটিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট।