শিক্ষার্থীদের আস্থার আরেক নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’
‘সবাই মিলে গড়ি নিরাপদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’এই স্লোগানকে সামনে রেখেই যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ। শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ভুমিকা রাখায় প্রশংসায় ভাসছে এই সংগঠনটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়াতে এই সংগঠনের কার্যক্রমও চোখে পড়ার মতো। তাদের রয়েছে রয়েছে একটি ফেসবুক পেজ ও একটি গ্রুপ।
শুধু শিক্ষার্থীদের বিপদে পাশে দাড়িয়ে ক্ষান্ত হয়েছে তাঁরা? না, এই সংগঠন অল্প সময়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনেক শিক্ষামূলক কাজও করেছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের বিনা খরচে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ। শততম বর্ষে দ্বিগুণ সংখ্যক বা ২০০ জন শিক্ষার্থীকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য আবেদন নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে ১০০ জনকে গ্রাফিক ডিজাইন ও ১০০ জনকে ফ্রিল্যান্স রাইটিং স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণ দেবেন তারা। সংগঠনটির স্বপ্নদ্রষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও হলের সদ্য সাবেক জিএস জুলিয়াস সিজার তালুকদার। কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার চিন্তা আসে?
জানতে চাইলে জুলিয়াস সিজার তালুকদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন, তাই কোন শিক্ষার্থী যদি এলাকার কোন প্রতিবেশী বা সন্ত্রাসী দ্বারা আক্রমণের শিকার হয় তখন বিষয়টি আমাকে খুবই ব্যথিত করে। আমার মতো অনেকেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে ফল পাওয়া যায়, তা বিচ্ছিন্নভাবে করলে পাওয়া যায় না।’
তিনি জানান, চলতি বছরের ১৮ জুন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে আম পাড়াকে কেন্দ্র করে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০০৬-০৭ সেশনের শিক্ষার্থী মেহেদী মোস্তফা। তখন এ চিন্তা মাথায় আসে যে, একটি প্ল্যাটফর্ম থাকলে এভাবে কেউ সামান্য বিষয় নিয়ে আক্রমণের শিকার হবে না।
তিনি বলেন, ‘এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিন্তাটি শেয়ার করলাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসে। তারমধ্যে অন্যতম হলো মেহেদী শামীম, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের সিনিয়র এএসপি মো: জুয়েল রানাসহ আরো অনেক। এরপরে ফেসবুক গ্রুপ আর পেজ খোলার মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।’
সংগঠনটির কাজ আরো ফলপ্রসূ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে চারটি টিম। সেগুলো যথাক্রমে-সাইবার সিকিউরিটি টিম, আইন সহায়তা টিম, প্রশাসনিক সহায়তা টিম ও নারী নিরাপত্তা টিম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের মডারেটর ও নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের সিনিয়র এএসপি মো: জুয়েল রানার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু নিয়েছি। কিন্তু যত নিয়েছি তত দিতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক আবেগ, ভালোবাসার নাম।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি যেহেতু পুলিশের কাজের সাথে জড়িত, তাই এ কাজ আমার পেশা ও নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করে যখন রাতে ঘুমাতে যাই, তখন মনের মাঝে যে প্রশান্তি তৈরি হয় তা কখনো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’ এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের ইতিবাচক কাজের দীর্ঘজীবীতা কামনা করেন জুয়েল রানা।
জানা গেছে, বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) তুচ্ছ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে নিজ বাড়িতে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ওই ছাত্রীকে গুরুতর আহতাবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ছাত্রীর নাম কেয়া আক্তার কাকলি। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার পােগলা ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সিনিয়র এএসপি মো: জুয়েল রানার প্রচেষ্টায় হামলাকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় স্থানীয় প্রশাসন।
কেয়া আক্তার কাকলির সাথেও মোবাইলে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। কথা বলার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে যান এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে গর্ববোধ করি। আজ আমার বিপদের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইয়েরা আমাকে যেভাবে সাপোর্ট করেছে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের অবদান কখনো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এখান থেকে পরবর্তীতে আর কেউ শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলার সাহস পাবে না।’
ইতোমধ্যে শিশু জিনিয়া অপহরণে সঠিক অনুসন্ধানে পুলিশকে সহায়তা করে এবং ক্যাম্পাসের এক ছাত্রীকে হয়রানি করা দুষ্কৃতিকারী ও মাদকাসক্তকে পুলিশে সোপর্দ করে প্রশংসা কুড়িয়েছে সংগঠনটির অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী আরাফাত চৌধুরী।
আরাফাত চৌধুরির সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা মঞ্চের মূল ভুমিকা হলো ঢাবির বর্তমান কিংবা সাবেক শিক্ষার্থীদের যদি বৈধ কোনো প্রকার আইনি কিংবা পুলিশি সাহায্যের দরকার পড়ে, তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সহায়তা করা। এই সেবাপ্রাপ্তির আওতায় শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই সীমাবদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের সাথে পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি যুক্ত রয়েছেন বিচারক এবং অ্যাডভোকেটরাও। তারা মূলত ঢাবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী। কোনো ঢাবিয়ান যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ গ্রুপে অভিযোগ জানিয়ে পোস্ট দেয়, মেসেজ দেয় কিংবা মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তবে আমরা অভিযোগকারীকে সহায়তা দেয়ার কার্যক্রম শুরু করি।’
তবে কেউ অবৈধ কাজ করার জন্য অন্যায় আবদার নিয়ে আসলে তা নাকচ করে দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মিশন হলো ঢাবিকে নিরাপদ ক্যাম্পাস করা এবং কোনো ঢাবিয়ান যাতে অন্যায়, অবিচার কিংবা হয়রানির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতে এর কার্যক্রম সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যদিও তা সময় সাপেক্ষ।’
জিনিয়াকে উদ্ধারের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তরুণ এই স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘জিনিয়াকে উদ্ধার করতে আমি দু’দিন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চষে বেড়িয়েছি। যখন জিনিয়াকে উদ্ধার করতে পারলাম তখন আমার মনে হলো আমি স্বর্গ ফিরে পেয়েছি। এ অভিজ্ঞতা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।’