০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২২:২৮

রাবিকে কলঙ্কমুক্ত চান শিক্ষকরা, শুনানি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

  © ফাইল ফটো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে উন্মুক্ত শুনানির আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে ইউজিসির শুনানি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

কেউ বলছেন, এর মাধ্যমে নিজেদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ খণ্ডনের মোক্ষম সুযোগ পাচ্ছেন অভিযুক্তরা। তবে ইউজিসি এ ধরনের অভিযোগের তদন্তে আইনগত কোন প্রতিষ্ঠান কিনা সে প্রশ্নও এসেছে বেশ জোরালোভাবে, যেহেতু ১৯৭৩ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলে রাবি।

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর মধ্যে এসব অভিযোগ সমাধানের উপায় নেই বলে জানিয়েছেন একজন শিক্ষক। তবে এসব শুনানি কিছুই না, আইওয়াশ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, ‘উনার বিরুদ্ধে যেহেতু এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘদিন থেকে উঠছে, ফলে উনি সে-সব অভিযোগ খণ্ডনের একটা উপযুক্ত সুযোগ পেয়েছেন। নিজের অবস্থানে যদি উনি সৎ থেকে থাকেন, সেটা প্রমাণ করার এটা একটা মোক্ষম সময়।’

ইউজিসিতে কেন গণশুনানি? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের সমস্যা নিজেরা তো সমাধান করতে পারছে না। এর আগে দেখলাম যে, নিয়োগ নিয়ে যে ফোনালাপ কেলেঙ্কারি প্রকাশ হলো, তখন উনি (উপ-উপাচার্য) নিজেই সংবাদ সম্মেলন করে বললেন যে, আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হোক।’

তিনি বলেন, ‘তখন সুপেরিয়র হিসেবে উপাচার্য চাইলে তো তদন্ত করতে পারতেন, কিন্তু করেননি আরকি। এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো, সেটা সত্য হোক মিথ্যা হোক, সারাদেশের মানুষ জানলো। ভিসি স্যার কি কোনো তদন্ত কমিটি করেছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কাঠামো সেটাতে এ ধরনের অভিযোগ সমাধানের কোন উপায় নেই। ফলে আমাদেরকে বাইরের হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে।’

এই শিক্ষক আরো বলেন, ‘এক্ষেত্রে ইউজিসি তাদের পরিসরেই করবে। এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে, একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে এসব নিয়ে আমি বিব্রত। আমি চাই, এর মাধ্যমে একটা সমাধান হোক। বিশ্ববিদ্যালয় কলঙ্কমুক্ত হোক।’

ক্যাম্পাসের বাইরে ইউজিসি আদৌ গণশুনানির এখতিয়ার রাখে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বর্তমান প্রশাসনপন্থী শিক্ষকরা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী তার ফেসবুক ওয়ালে প্রশ্ন তুলেছেন।

অধ্যাপক মামুনের ভাষ্যমতে, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত। তাতেই পাওয়া যাবে উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের উপায়। ১৯৭৩ সালের অ্যাক্টকে উপেক্ষা করে ইউজিসি যে প্রক্রিয়ায় গণশুনানি করতে যাচ্ছে তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মানহানিকর। ইউজিসির উচিত তার তদন্ত দলকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করা।’

তিনি লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মর্যাদা সুরক্ষা করা ইউজিসির দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। ইতোপূর্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে একইরকম পরিস্থিতি তদন্ত করতে ইউজিসির তদন্ত দল উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে গিয়েছিলো, তলব করেনি।’

গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জুলফিকার আলি বলেন, ‘এসব শুনানি অনেকটা আইওয়াশ টাইপের হয়। এগুলোতে তেমন কিছু হবে না। কোন আমলে দুর্নীতি হয়নি? একটা বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে গেলে কিছু নিয়ম-অনিয়ম তো হবেই? আমি ক্যাম্পাসের বাইরে স্পেসিফিকলি কিছু বলতে পারব না। তবে আগে থেকেই নোংরামি তো চলে আসছে যে, একজনের বিরুদ্ধে আরেকজন লেগে থাকা।’

তিনি বলেন, ‘উনাকে (উপাচার্য) শেষের দিকে ডিস্টার্ব করলে মনে করবে যে, ভালোভাবে চালায় নাই এসব আরকি! প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই এসব অভিযোগ বলে জানান তিনি।

ইউজিসি অডিটোরিয়ামে শুনানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউজিসি তো লিগ্যাল কোনো বডি না? এখানে কোর্টের মতো সমন জারি করে উনাকে হাজির করছে না। তারা হয়তো উনার সাথে সাক্ষাত করতে চাইছে বা মতবিনিময়ের মতো হবে। এটাকে ফলাও করে প্রচার করে তার (ভিসি) মর্যাদাহানি করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।’ এক্ষেত্রে স্যারকে না ডেকে ইউজিসির তদন্ত দল ক্যাম্পাসে আসলে ভালো হতো বলে মনে করেন অধ্যাপক জুলফিকার।

ইউজিসি পর্যন্ত যাওয়াটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা হানিকর অভিহিত করে রাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘একটা ঘটনা যে ইউজিসি পর্যন্ত গেছে, এ পর্যন্ত যাওয়াটাই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় জন্য খুব খারাপ দিক। এসব অভিযোগ কেনইবা উঠবে? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে সবখানে স্বচ্ছতা থাকা উচিত, সেখানে এসব অভিযোগ তো আসলে উঠাই উচিত না।’

তিনি বলেন, ‘ইউজিসির যে তদন্তসীমা বা দায়িত্ব কাঠামো তাতে তারা এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত করতে পারে কিনা বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ অভিযোগগুলো আদৌ সত্য কিনা? যদি সত্য হয় এসবের একটা বিহিত হওয়া উচিত। যেহেতু অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর এবং একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা হানিকর। তাই খতিয়ে দেখতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রমাণিত হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত, যদি অভিযোগ ভিত্তিহীন হয় তাহলেও ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপার আছে।’

আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর ইউজিসি অডিটরিয়ামে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। রাবি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকদের একাংশ ‘দুর্নীতি বিরোধী শিক্ষক সমাজ’-এর আনা অভিযোগের ভিত্তিতে এ শুনানি করছে ইউজিসি।

চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি উপাচার্যের দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত’-সংবলিত ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) দাখিল করেন তারা। সেখানে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে মোট ১৭টি অভিযোগ আনা হয়।