২৫ আগস্ট ২০২০, ০৮:৪৪

ইতিহাস-ঐতিহ্যের গৌরবময় পথচলায় ঢাকা কলেজ

ঢাকা কলেজের প্রথম ভবন

উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪১ সালে। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই ঢাকা কলেজই বিদ্যার্থীদের সম্মুখে পাশ্চাত্যের কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শনকে উন্মোচিত করেছিল। কালের আবর্তে প্রায় পৌনে দুই শতাব্দী পেরিয়েছে ‘ঢাকা কলেজ’। ১৭৯ বছরের পথচলায় মেধাধীদের পছন্দের তালিকায় এখনও শীর্ষে ঢাকা কলেজ। ১৯৯২ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা এই কলেজটিকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।

শুধু এ দেশের শিক্ষার ইতিহাসেই নয়, বরং জাতির ইতিহাসেও এক অনন্য অধ্যায়ের নাম ‘ঢাকা কলেজ’। ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান গৌরবের বিজয়গাথাঁকে করেছে মহিমান্বিত। এ কলেজের কৃতী, মেধাবী ও যশস্বী শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ স্বনামখ্যাত। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা কলেজকেও করেছেন গৌরবান্বিত।

দেশের সবচেয়ে প্রাচীন আর ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা পেছনেও রয়েছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। ১৮৩৫ সালের ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করেন যাতে উল্লেখ করা হয়-

“সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।”

পরবর্তীকালে এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হলে ঢাকার সে সময়ের সিভিল সার্জন ডা. জেমস টেইলার জানান, এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব সুবিধা (আর্থিক এবং সামাজিক) পাওয়া যাবে।

মূলত তখন থেকেই শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি, যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।

এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে একদিকে যেমন বদলে যেতে থাকে সমাজের সামগ্রিক চালচিত্র, তেমনি বিদ্যার্থীদের মানসসম্মুখে পাশ্চাত্যের কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শন উন্মোচিত হতে থাকে। শিক্ষা এবং সমাজব্যবস্থার এ ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে সে সময়ের গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কতগুলো কেন্দ্রীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

এই সুপারিশের প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত ব্যয়ের কথা উল্লেখ করে এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা তার যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮৪১ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ। প্রতিষ্ঠার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে.আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

এ কলেজ প্রতিষ্ঠার পরপরই বদলে যায় সমগ্র ঢাকার চিত্র। ঢাকা হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলার ইংরেজি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র।

এরপর ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকা কলেজকে এর অধিভুক্ত করা হয়। সে সময় থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণ করতে থাকেন ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। ১৮৫৬ সালে গণিতশাস্ত্রের পন্ডিত অধ্যাপক ব্রেনান্ডকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

এরপর ১৮৭৫ সালে ঢাকা কলেজ একটি বড় সম্মান লাভ করে। সে বছর ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান শাখা খোলা হয়, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন নতুন বিষয় পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকা কলেজে পড়তে আসা ছাত্রদের তথ্য প্রথম পাওয়া যায় ১৮৪৩ সালে।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন সময়ে ১৫ জন ছাত্র বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে সাতজন ফরিদপুর, দু’জন বরিশাল, দু’জন যশোর, দু’জন ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন। এছাড়া ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকেও ভর্তি হয়েছিলেন দুই ছাত্র।

এভাবে ঢাকার বাহিরের শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তি হবার ফলে কলেজের নিজস্ব ছাত্রাবাস বা হোস্টেল জরুরি হয়ে উঠে। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজে কোন ছাত্রাবাস গড়ে ওঠেনি। এ দীর্ঘ সময়ে ছাত্ররা তাই নানাবিধ কষ্টের মধ্যেই তাদের জীবন অতিবাহিত করেন। যদিও ১৮৭৪ সালে ঢাকায় একটি ছাত্রাবাস গড়ে ওঠে, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীতে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে ১৮৮০ সালে ঢাকা কলেজের জন্য বাংলাবাজারের শ্রীদাস লেনে রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল নামে প্রথম ছাত্রাবাস নির্মিত হয়।

এরপর হোস্টেলের ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ১৮৮৩-৮৪ সালে বোর্ডারের সংখ্যা ৯০-এ দাঁড়ায়।

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৪ সালের ২৭ মে এক সরকারি সভায় ঢাকা কলেজের জন্য একটি আধুনিক ছাত্রাবাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে নতুন দুটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে বহু ছাত্র উপকৃত হন।

হোস্টেলের নাম রাখা হয় সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজের হিন্দু হোস্টেল রূপান্তরিত হয়ে হয় ঢাকা হলে, যা বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল এবং সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের মুসলিম হোস্টেলটি হয়ে যায় মুসলিম হল, যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল।

এরপর নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৫৫ সালে কলেজটিকে বর্তমান জায়গার (ধানমন্ডিতে) স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত করা হয়। এখানে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১৯টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু রয়েছে। ছাত্রদের আবাসন ও যাতায়াতের সুবিধা দিতে রয়েছে আটটি ছাত্রাবাস ও ৮ টি বাস। এখনো গৌরবের ১৭৯ বছরের পথচলায় মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে হাজার হাজার বিদ্যার্থীদের ভবিষ্যত কান্ডারীতে রূপান্তর করতে সবসময়ই জ্ঞানের আলো দান করে যাচ্ছে ঐতিহ্যের বিদ্যাপিঠ ঢাকা কলেজ।

অতীতের মতো এখনও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে এই কলেজের ছাত্ররাই। গৌরবের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে আগামী প্রজন্মও এমনই প্রত্যাশাই সকলের।