অনলাইন ক্লাস রেকর্ড চান শিক্ষার্থীরা, অনীহা শিক্ষকদের
চারমাসেরও বেশী সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় সম্প্রতি অনলাইন ক্লাস শুরু করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আর ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাসও শুরু করেছে।
কিন্তু আর্থিক সমস্যা, নেটওয়ার্ক সমস্যা এবং ডিভাইস না থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এই অনলাইন ক্লাসের বাইরে থাকছেন। ক্লাসের বাইরে থাকা এসকল শিক্ষার্থীরা সমস্যা নিরসনে অনলাইন ক্লাসসমূহ রেকর্ড করার দাবি জানালেও বেশিরভাগ শিক্ষকরাই ক্লাস রেকর্ড করার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহসান জোবায়ের বলেন, স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশে অনলাইন ক্লাসের বাস্তবতা নেই। তারপরও বিভিন্ন দিক বিবেচনায় ইউজিসি থেকে অনলাইন ক্লাসের নির্দেশনা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগেই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নেটওয়ার্ক সমস্যা উপযোগী ডিভাইস না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শিক্ষকদের প্রতি সকল ক্লাসের রেকর্ড পরবর্তীতে ফেসবুক ও ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে আপলোড করার নির্দেশনা দেয়া হলেও সেটিও করা হচ্ছে না।
জবির এ শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাসের রেকর্ড ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করা হলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতো। যে সকল শিক্ষার্থী নানাবিধ সমস্যার কারণে লাইভ ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, তারা পরবর্তীতে যে কোনো সময়ে ক্লাসের ভিডিও দেখে নিতে পারতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও কোনো বিভাগেই শিক্ষকরা রেকর্ড সরবরাহ করছেন না। এমনকি কিছু বিভাগের শিক্ষকরা ক্লাসের রেকর্ড না করতে কঠোরভাবে নিষেধ করছেন।
জোবায়ের জানান, অনলাইন ক্লাস রেকর্ডিংয়ের বিষয়ে শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত না হওয়ায় রেকর্ড না করার কথা বলেন। আবার কেউ কেউ এ বিষয়ে বিভাগের চেয়ারম্যানের নির্দেশনা না থাকাকে দায়ী করেছেন।
বিষয়টি স্বীকার করে জবি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শিপ্রা সরকার বলেন, শিক্ষার্থীদের অভিযোগের জায়গাটি ঠিক আছে। আমাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে শুরুর দিকে ক্লাস রেকর্ডিংয়ের বিষয়টি নিয়ে একটু সমস্যা ছিল। অনেকে এই পদ্ধতির সঙ্গে নিজেকে খাপখাইয়ে নিতে পারছিলেন না। তবে এখন সমস্যা কেটে গেছ, সব ক্লাস এখন আমাদের রেকর্ড হচ্ছে।
অনলাইন ক্লাস রেকর্ডিংয়ের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুয়াদ পাবলো বলেন, সার্বিকভাবে আমি অনলাইন ক্লাসের পক্ষে না। আর যদি অনলাইন ক্লাস হতেই হয়, তাহলে ক্লাবের রেকর্ড চাই। কারণ একটা বড় অংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে লাইভ ক্লাসে অংশ নিতে পারে না।
রাবি শিক্ষার্থী ফুয়াদ মনে করেন রেকর্ড করলে শিক্ষকদের অনেক জড়োসড়ো ক্লাস নিতে হয়, এটা সত্যি। কিন্তু আমার হয় বিশেষ পরিস্থিতির কারণে শিক্ষকদেরও এইটুকু ছাড় দেয়া উচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক বলেন, আসলে ক্লাসটা হলো উন্মুক্ত, এখানে সব বিষয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে সেন্সরটা শিক্ষকদের জন্য একটা উদ্বেগের কারণ। কারণটা হচ্ছে আমি যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো, ওপেন ক্লাসে মুক্ত চিন্তার জায়গা থেকে বললে নলেজের জায়গায় কোন পলিটিক্যাল মতামত চলে না।
তিনি বলেন, জ্ঞানকে সেখানে তার সহজাত এবং যথাযথ উপস্থাপন সেটাই করতে হবে। এখন সে নলেজকে উন্মুক্ত প্রকাশ করতে গিয়ে সরকার যদি আমার ক্লাস লেকচারে হস্তক্ষেপ করে, সেটাকে যদি ডকুমেন্ট হিসেবে হাজির করে সেটা শিক্ষকদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
ক্লাস রেকর্ডিংয়ের বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিভাগে অনলাইন ক্লাসগুলো রেকর্ড করার নির্দেশনা রয়েছে। তাই শিক্ষকদের সম্মতি ছাড়া শিক্ষার্থীরাও ক্লাস রেকর্ড করতে পারছে না। অনেক শিক্ষার্থী লাইভ ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। তারাও যাতে ক্লাসগুলো দেখার সুযোগ পায় এ কারণে সবাই চায় ক্লাসের রেকর্ড করা হোক। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে তা সম্ভব নয়।
ববির এ শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষকরা বলেছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্লাসগুলো পুনরায় নেয়া হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় বোঝানোর জন্য রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা হয়। এসকল বিষয়গুলো বেশ সেনসেটিভ। একারণেই মূলত ক্লাস রেকর্ড করা হচ্ছে না। কারণ এসকল ক্লাসের খন্ডিত ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে বিতর্ক তৈরি করা হতে পারে।
তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সুব্রত কুমার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক বিভাগেই অনলাইন ক্লাস রেকর্ড করা হচ্ছে। এই বিষয়টি মূলত বিভাগগুলোর উপরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিভাগগুলো নিজেদের মত করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ক্লাসগুলো রেকর্ড করা হবে কিনা।
ক্লাস রেকর্ডিংয়ের দাবি জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম বলেন, নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে আমাকে বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে ক্লাস করতে হয়। এখানে আবহাওয়া খারাপ থাকলে আমি ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারিনা। যদি আমাদের ক্লাসগুলো রেকর্ডের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও পরে তা দেখার সুযোগ পাওয়া যেতো। তাই আমি চাই আমাদের মত শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ক্লাসগুলো রেকর্ড করা হোক।
কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন কারণে ক্লাস রেকর্ডিংয়ের বিষয়ে অনীহা রয়েছে অধিকাংশ শিক্ষকের। এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. হাসিবুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের শিক্ষকরা এখনো অনলাইন ক্লাসে পুরোপুরি অভ্যস্ত নয়। আবার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর স্বার্থে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এসকল ক্লাসের খন্ডিত অংশের ভিডিও প্রকাশ করে বিতর্ক তৈরি করা হতে পারে। যা দিয়ে শিক্ষকদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা হতে পারে। মূলত এসকল কারণেই ক্লাসের রেকর্ড করা হচ্ছে না।