চবিতে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত ছাত্রদল-শিবির, মাথাচাড়া দিচ্ছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রদল ও বামপন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ছাত্রশিবিরের দ্বন্দ্বের মধ্যেই মাথাচাড়া দিচ্ছে নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত অবস্থান জানান দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করতে মরিয়া সংগঠনটি। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিকৃত পোস্টার সাঁটিয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৪ ডিসেম্বর একটি আলোচনা সভায় ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বক্তব্য দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মো. শামিম উদ্দিন খান। তার পদত্যাগের দাবিতে পরদিন ১৫ ডিসেম্বর প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে আন্দোলন শুরু করে ছাত্রদল। এতে অংশ নেন বামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। ছাত্রদল নেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সহ-সাধারণ সম্পাদক আইয়ুবুর রহমান তৌফিকও এই আন্দোলনে ছিলেন।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে: চবি উপ-উপাচার্য
পরে ভিপি ও ছাত্রশিবির নেতা ইব্রাহিম হোসেন রনির নেতৃত্বে চাকসুর অন্য প্রতিনিধিরা মীমাংসা করতে গেলে উভয় পক্ষে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ইব্রাহিম হোসেন রনির পক্ষে যোগ দেয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। এর জেরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি তকিবুল হাসান চৌধুরী তকির নেতৃত্বে হাটহাজারী ও আশেপাশের ছাত্রদল-বিএনপি নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক অবরোধ করে এক ঘণ্টা অবস্থান করে। পরে বিজয় দিবসের মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয় ছাত্রদল ও বামপন্থী সংগঠনগুলো।
যেমন সরকারের দায় রয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর বিচার না হওয়ায় তারা বারবার এমন কর্মকাণ্ডের সাহস পাচ্ছে— মোহাম্মদ আলী, চবি শিবির সভাপতি
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ছাত্রশক্তিসহ (অধুনা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ) অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ের ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য। এর ফায়দা নিয়েছে কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ।
এতদিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেই সক্রিয় দেখা গেছিল চবি ছাত্রলীগের পলাতক নেতাকর্মীদের। এর মধ্যে সংগঠনটির চবি শাখার সহ-সভাপতি আবরার শাহরিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় মুখ। পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছে। জুলাই গণহত্যা চলাকালে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় অন্যতম আসামী হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক সক্রিয় শাহরিয়ার। ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরাঘুরির সচিত্র পোস্ট নিয়মিতই দেন ফেসবুকে।
আরও পড়ুন: চবির প্রশাসনিক ভবনে তালা, ছাত্রদল-বামদের সঙ্গে শিবিরের মুখোমুখি অবস্থান
একই সঙ্গে সংগঠনটির সাবেক সহ-সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাবরিনা চৌধুরীও সক্রিয় রয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সাবরিনা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এ ছাড়া নিজ এলাকা চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে গোপনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও অংশ নেন তিনি, যা প্রকাশ করেন ফেসবুকে। শুধু অবস্থান আর ঘোরাঘুরিই নয়, এর আড়ালে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচির সমন্বয় করেন এ দুই নেতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা নিজেরাই এসব কার্যক্রমের জানান দেন।
জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তারা ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর কর্মকাণ্ডে জড়াবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে— সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়, সাংগঠনিক সম্পাদক, চবি ছাত্রদল
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দু’জন ছাড়াও আরও অনেক নেতাকর্মীই প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও তাদের ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অপর দিকে ছাত্র সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্যাম্পাসেও নিজেদের জাল বিস্তার করছেন তারা। মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) গভীর রাতে প্রধান উপদেষ্টা ও অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যের ব্যাঙ্গাত্মক ছবিসহ পোস্টার টানানোর ঘটনায় এ দু’জনের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আবরার শাহরিয়ার ও সাবরিনা চৌধুরীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এই বিকৃত ছবি সাঁটানো হয়েছে ক্যাম্পাসে।
ক্যাম্পাসে প্রধান উপদেষ্টার বিকৃত ছবি সাঁটানোর বিষয়ে অবস্থান জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ভোর ৪টা ১ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একটি স্থানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যঙ্গাত্মক ছবি সাঁটানো হয়। বিষয়টি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেটি সরিয়ে ফেলি। সিসিটিভি ফুটেজে সংশ্লিষ্টদের দেখা গেলেও তারা মুখে মাস্ক ও গায়ে হুডি পরা ছিল, পাশাপাশি কুয়াশার কারণে তাদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে, পলাতক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের যথাযথ বিচার না হওয়ায় তারা মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা জোরদারেও গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
সিসিটিভি ফুটেজে সংশ্লিষ্টদের দেখা গেলেও তারা মুখে মাস্ক ও গায়ে হুডি পরা ছিল, পাশাপাশি কুয়াশার কারণে তাদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে— অধ্যাপক ড. হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী, প্রক্টর
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের পরিকল্পিত কাজ বলে আমরা মনে করি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশের বাইরে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যেমন সরকারের দায় রয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর বিচার না হওয়ায় তারা বারবার এমন কর্মকাণ্ডের সাহস পাচ্ছে। আমরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।
শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, পতিত সরকারের নিষিদ্ধ গোষ্ঠীই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে আমরা মনে করি। তারা পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই আগুন সন্ত্রাসসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। আমাদের জুলাই যোদ্ধা শরীফ ওসমান হাদীর ওপর হত্যাচেষ্টাও এরই অংশ। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তারা ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর কর্মকাণ্ডে জড়াবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার দাবি জানান তিনি।