স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকসুর ভিপি-জিএস পদে জিততে পারেননি কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) দীর্ঘ ইতিহাসে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) ও জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদ দুটি সব সময়েই রাজনৈতিক মেজাজে গড়া হয়েছে। ফলে এ দুই পদে কখনোই জয় পাননি কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলীয় রাজনীতির প্রভাবশালী অবস্থান ও শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ধারা ভোটের ফল নির্ধারণ করেছে প্রতিবারই।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। তিনি ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ থেকে সমাজসেবা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন আখতার হোসেন। তিনি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব। এ নির্বাচনে ২৫ পদের মধ্যে ২৩টিতে জয় পেয়েছিল ছাত্রলীগ। তবে ১৯৭২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আটটি নির্বাচনে ভিপি কিংবা জিএস পদে জয় পান সরকারবিরোধী প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানো কেউই এ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকসুর ভিপি-জিএস পদ সব সময়ই গুরুত্ব বহন করে। শিক্ষার্থীরা এই দুটি পদে ভোট দেওয়ার সময় সরকারের জনপ্রিয়তা, শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ও সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেন। ফলে টানা আট নির্বাচনে সরকারপন্থী কিংবা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের ভরাডুবি হয়েছে। তাদের মতে ডাকসুর ভিপি পদ মূলত শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মত প্রকাশ ও আন্দোলনের প্রতীক। তাই এখানে সরকারবিরোধী বা বিকল্প ধারার প্রার্থীরাই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছেন।
ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যতগুলো ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার একটিতেও ভিপি-জিএস পদে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেনি। যদিও ডাকসুতে স্বাধীনতার পর মোট ৮ বার নির্বাচনের পর যারা নের্তৃত্বে এসেছেন; তারা সবাই বাংলাদেশের রাজনীতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন।
স্বাধীনতার পর যারা ডাকসুতে এসেছেন তাদের পরিচয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণত সরকার-সমর্থকরা ভোটের মাধ্যমে জেতেন না। ব্যতিক্রম কেবল ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে। যদিও এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনের পর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের কোনো নেতা ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে জয় পায়নি। ২০১৯ সালের ডাকসুতে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে জিএস-এজিএসসহ ২৩ জন জয়ী হয়েছিলেন।
তথ্যমতে, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ডাকসু নির্বাচন ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বে দেয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। অন্যদিকে জিএস হন একই সংগঠনের মাহবুবুর জামান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সময়কালে ডাকসুর দুটি পদের দায়িত্ব পালন করেন সংগঠনটির এই দুই নেতা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। প্রথম দুই নির্বাচনে যথাক্রমে জাসদ-ছাত্রলীগের এবং বাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জিতেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মদদপুষ্ট কোনো নেতা ওই সময় জয় পাননি।
১৯৮২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৮৯ পর্যন্ত ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন আখতারুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও ১৯৮৯-৯০ সেশনে ছাত্রলীগ থেকে ভিপি’র দায়িত্ব পালন করেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদ পান মুশতাক আহমেদ। মুশতাক আহমেদ সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছিলেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন; যদিও সে সময় তাদের মূল দল বিএনপি ক্ষমতাসীন ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবেই ডাকসুতে ক্ষমতাসীনদের খবরদারিত্ব খর্ব হয়েছে।
পেছন ফিরে দেখা
১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সৃষ্টি হয়। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন এ এম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী, ১৯২৯-৩২ সময়কালে রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান, ১৯৪৭-৪৮ সেশনে অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম, ১৯৫৩-৫৪ সালে এস এ বারী এটি ও জুলমত আলী খান, ফরিদ আহমেদ। এরপর ভিপি ও জিএস নির্বাচিতদের মধ্যে যথাক্রমে রয়েছেন নিরোদ বিহারী নাগ ও আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক ও শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম ও মো. ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন ও এটিএম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা ও আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আখতার ও অমূল্য কুমার, এস এম রফিকুল হক ও এনায়েতুর রহমান, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কে এম ওবায়েদুর রহমান, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন ও আসাফুদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম ও মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী, আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন।